অন্যায়ের বিপরীতে নীরবতার চেয়ে বড় পাপ নেই
প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৭, ২২:১৯
হঠাৎ অনেকদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে খুব খারাপ লাগছে। তাই এই গভীর রাতে বিছানার আরাম ছেড়ে উঠে একটা অপরাধের স্বীকারোক্তি লিখতে বসেছি।
প্রথমবার এসএসসি ফেল করবার পর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিতে গেছি সিলেট এইডেড হাই স্কুলে। আমার ঠিক সামনের বেঞ্চেই বসেছিল একটা ছোটখাটো মিষ্টি চেহারার মেয়ে। পরীক্ষা শুরু হবার কিছুক্ষণ পরই মেয়েটা দাঁড়িয়ে ইনভিজিলেটরকে বলল তার বাথরুম পেয়েছে। পরিদর্শক মহিলাটি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, 'পরীক্ষা শুরু হবার আগে যেতে পারোনি? চুপচাপ বসে লিখ'।
একটু পর মেয়েটা আবার উঠে দাঁড়িয়ে মিনতির সুরে টয়লেট যাওয়ার অনুমতি চাইলে মহিলা একেবারে তেড়ে এলেন, 'প্রশ্ন দেখেই টয়লেট পেয়ে গেছে না? বইপত্র সব সেখানে রেখে এসেছ, তাই তো? চুপ করে বসে লিখ'।
কিছুক্ষণ পর শুনলাম মেয়েটা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। মহিলা কিছুক্ষণ পরপর তার পাশে এসে বকাবকি করে যাচ্ছেন। মেয়েটা কিছুই লিখছে না। এভাবে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল। অনেকখানি সময় পেরিয়ে যাবার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম ফ্লোরে একটা পানির ধারা বয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। তার বেঞ্চের অন্য মাথায় বসা মেয়েটা ইনভিজিলেটরকে ডাকলে কাছে এসে তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন। আমি ভেবেছিলাম তিনি আবার চেঁচিয়ে উঠবেন, কিন্তু তিনি একটা শব্দও বললেন না। কোন সান্ত্বনা, অনুশোচনা, ক্ষমা প্রার্থনা, প্রতিকার- কিছুই না।
কিছুই ঘটেনি এমন একটা ভাব নিয়ে তিনি জুতার খটখট শব্দ তুলে কামরার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত পায়চারী করে তার কাজ করে যেতে লাগলেন। মেয়েটা অনবরত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। আমি মন দিয়ে লিখতে পারছিলাম না। কান্না পাচ্ছিল আমারও। আমরা এতোগুলো ছাত্রীর কেউ কিন্তু একটুও প্রতিবাদ করলাম না, ভাবলে অবাক লাগে।
প্রথমার্ধের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে মেয়েরা সবাই একে একে বের হয়ে গেল। মেয়েটা বসে থাকল পাথরের মত। তার ঠিক পেছনে আমিও হতভম্বের মত বসে রইলাম। একটু পরে একটা ছেলে এসে ঢুকলো, সম্ভবত তার ভাই হবে। কেউ নিশ্চয়ই তাকে খবর দিয়েছে। সে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, 'বাসায় চল।' মেয়েটা একটুও নড়লো না। ভাই তার হাত ধরে বলল, 'চল। পাস্ট ইজ পাস্ট। কাঁদিস না।'
দ্বিতীয়ার্ধের পরীক্ষায় আমার সামনের সিটটা খালি ছিল। ফ্লোরের প্রস্রাব তখনো পরিষ্কার করা হয়নি। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের দুর্গন্ধে ভরপুর কামরাটায় আমরা একদল স্বার্থপর, মেরুদন্ডহীন মেয়ে মুখস্ত করা একগাদা মিথ্যা নীতিবাক্য কাগজের উপর উগলে চলেছি।
জানি না পরবর্তীতে মেয়েটার পরিবার এই বিষয়ে কিছু করেছিল কি না। নাকি তারাও আমাদের মতই মেরুদন্ডহীন ছিল, 'পাস্ট ইজ পাস্ট' বলে চুপ করে সয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ হলে হয়তো এ নিয়ে লেখালেখি হতো, প্রতিবাদ হতো।
এরকম ঘটনা স্কুল জীবনে আরো দু'একটা দেখেছি কিন্তু কোনবারই প্রতিবাদে ফেটে পড়িনি। জীবনে নিজের কৃত অপরাধ বা পাপের হিসাব করলে সেদিনের নীরবতাকে হিসেবে না ধরে পারি না। পাস্ট আসলে পাস্ট হয় না, বর্তমানে ফিরে এসে বারবার নিজের দুর্বলতা আর নিষ্ক্রিয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্যায়ের বিপরীতে নিরবতার চেয়ে বড় পাপ আর কিছুই হতে পারে না।
জেসমিন চৌধুরীর ফেসবুক থেকে