প্রতিরোধের মার্চ

১৯৭১ এর উত্তাল ৬ মার্চ

প্রকাশ | ০৬ মার্চ ২০১৭, ২১:০২

অনলাইন ডেস্ক

সংগ্রামী বাংলা এখন সভা-সমাবেশ-মিছিলে উত্তাল। ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তাঁরই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে ইতোপূর্বে বেতন দেয়া হয় নি সে-সব অফিস বেতন প্রদানের জন্য খোলা রাখা হয়েছিল। একই সঙ্গে বীর বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে কী ভাষণ দেবেন তার জন্য প্রতীক্ষা করছিল।

এদিন সকাল ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদী নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়।

অন্যদিকে ৬ মার্চ লে.জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অপসারণ করে লে.জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই উত্তপ্ত সময়ে নৃশংস বলে কুখ্যাত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণের উদ্দেশ্য যে মিলিটারির বুটের নিচে পূর্ব পাকিস্তানের গণ আন্দোলনকে দাবিয়ে দেয়া। এটা উপলব্ধি করতে পেরে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানের শপথনামা পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন। 

ঐদিন পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন যদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি তদ্দিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করবো।

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়াকিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘন্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তাঁর দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রে মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।

লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ-শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।

পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত অভিনন্দিত করে বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধান আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহয়া খান লে.জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের সকল বেতার কেন্দ্র থেকে রিলে করার দাবি জানান।

এছাড়া খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৮ জন শহীদ এবং আহত হয়েছিলেন ৬৪ জন।

চট্টগ্রামে আগের দিন বিহারী-বাঙালি শান্তি কমিটি গঠন হবার পরও আজ পাকি আর্মির সহায়তায় বিহারীরা ও পাকিবন্ধু কিছু বাঙালি হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুন্ঠন করে। লুন্ঠনের সময় স্থানীয় হিন্দু ও পুরোহিতদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।

এই ঘটনা বিহারী, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সাথে সাধারণ বাঙালিদের সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালে। রেলওয়ে কলোনী, হালিশহর, আগ্রবাদ ও নিউমার্কেট এলাকায় বাঙালি-বিহারীর সংঘর্ষ হয়। আন্দরকিল্লা, ফিরিঙ্গী বাজার, আসাদগঞ্জ, চকবাজারে সাধারণ বাঙালিদের সাথে বিহারী-জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।

তথ্যসূত্র
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
৭১ এর বিভিন্ন সংবাদপত্র