আজ টাঙ্গাইল মুক্ত দিবস
প্রকাশ | ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:১৮ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:২১
আজ ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার দামাল সূর্যসেনারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে। উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। যুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ লড়াইয়ের কাহিনী দেশের সীমানা পার হয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ বীরত্বের কথা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রশাসন পরিচালিত হয়। ২৬ মার্চ সকালে আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। তৎকালীন এমপিএ ও আওয়ামী লীগ নেতা বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপিএকে আহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর প্রধান এবং আরো ৮ জনকে সদস্য করে কমিটি গঠিত হয়।
টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তানদের মধ্যে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র্রের আব্দুল মান্নান, টাঙ্গাইল, জামালপুর এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত শামছুর রহমান খান শাজাহান ছিলেন অগ্রগন্য। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। শেষ পর্যন্ত এর সংখ্যা দাড়ায় ১৭ হাজারে। এক পর্যায়ে টাঙ্গাইলে গঠন করা হয় কাদেরিয়া বাহিনী।
গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হওয়ার পর চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল শহর দখল করে। টাঙ্গাইল আসার পথে মির্জাপুরের সাটিয়াচরায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাঙালি ইপিআর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পিছু হটলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালায়। তারা গ্রামে ঢুকে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। টাঙ্গাইল দখলের পর কালিহাতী ও মধুপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখানেও পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে আসে। তারা নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ ও সংগঠিত হতে থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী। শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ। খন্দকার আব্দুল বাতেন বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত `বাতেন বাহিনী` অনেক জায়গায় হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। চারদিক থেকে আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী।
টাঙ্গাইলে ৮ ডিসেম্বর প্রায় ৫ হাজার পাকিস্তানি সেনা এবং ৭ হাজার রাজাকার আলবদর অবস্থান করে। খান সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যমুনা নদী পথে পাঠানো হয় সাতটি জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কাদেরিয়া বাহিনী গোপনে এই খবর পেয়ে কমান্ডার হাবিবুর রহমানকে দায়িত্ব দেয় জাহাজ ধ্বংস করার জন্য মাইন পোতার কাজে। জীবন বাজি রেখে মাটিকাটা নামক স্থানে জাহাজে ঘটানো হয় বিস্ফোরণ। দুটি জাহাজে দুই রাত, দুই দিন ধরে চলতে থাকে অনবরত বিস্ফোরণ। বাকি জাহাজগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার বিভিন্ন স্থানে। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ ও গোলাবারুদ ধ্বংসে খান সেনারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাস্ত করে পাকিস্তানি বাহিনীকে।
এসব যুদ্ধে তিন শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের টাঙ্গাইল অঞ্চলের প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যোদ্ধাদের নিয়ে সখিপুরের সহানন্দা ও কীর্ত্তনখোলায় গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য দূর্গ। একের পর এক আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা যখন জেলার অন্যান্য স্থান থেকে এসে যখন টাঙ্গাইল শহরে অবস্থান নেয়, তখন উত্তর ও দক্ষিণ টাঙ্গাইল ছিল সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল শহরে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। পুংলি নামক স্থানে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সংর্ঘষ হয় পাকিস্তানি সেনাদের। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণভয়ে পাকিস্তানি সেনারা সারা রাত ধরে টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, চার দিক থেকে সাড়াশি আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের টাঙ্গাইল থেকে বিতারিত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভোলা। ১১ ডিসেম্বর সকালে কমান্ডার বায়েজিদ ও খন্দকার আনোয়ার টাঙ্গাইল পৌঁছেন। আসেন বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান।
১১ ডিসেম্বর ভোরে কাদেরিয়া বাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে দখলে নেন এবং শহরকে শত্রুমুক্ত করেন। এরপর তারা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেন। টাঙ্গাইল শহর সম্পূর্ণ হানাদারমুক্ত হয়। মানুষ নেমে আসে রাস্তায়।‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে টাঙ্গাইল শহর।
মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর ১৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৫০০ জন আহত হন। এই বাহিনী থেকে ১৭ জনকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়।