৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ
প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:৩০
সারা দেশে চলছে যুদ্ধ। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধ। পুরো বাংলাদেশে একের পর এক পতন ঘটছিল পাক-হানাদারবাহিনীর শক্ত ঘাঁটিগুলো। গ্রাম থেকে পিছু হটে তারা শহরে এসে অবস্থান নিতে শুরু করে। কিন্তু ফিরে আসার পথে আশেপাশের গ্রামগুলোতে ব্যপক হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালায়। দেশের এক-চতুর্থাংশ স্থান মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। মুক্তাঞ্চলগুলোতে মুজিবনগর সরকারের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেক্টর কমান্ডাররাও তাঁদের নিজ নিজ সেক্টর হেডকোয়ার্টার মুক্তাঞ্চলগুলোতে স্থানান্তরিত করেন। প্রায় ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধা তখন বীর বিক্রমে রণাঙ্গনে লড়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ক্যাম্পর প্রশিক্ষণরত ছিলেন ১৫ হাজারেরও বেশি তরুণ। শরণার্থী শিবির থেকে কত মানুষ যে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার হিসেব নেই।
৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর বিমানবাহিনী ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখল করে নেয়। বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। আর জাতিসংঘে বাংলাদেশকে নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সব বিমান বিধ্বস্ত হয়ে যায় যৌথবাহিনীর আক্রমণে।
এদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন সরকারের বিশেষ উদ্যোগে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বসে। এতে যুদ্ধ বিরতির জন্য মার্কিন প্রতিনিধি সিনিয়র বুশের চেষ্টায় সোভিয়েত প্রতিনিধি কমরেড মালিক ‘ভেটো’ প্রয়োগ করেন। ‘ভেটো’ প্রয়োগের পূর্বে কমরেড মালিক বলেন, ‘পাক সামরিক জান্তার নিষ্ঠুর কার্যকলাপের ফলেই পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে।’
মূলত, বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষদে তৃতীয় প্রস্তাবটি পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান।
এদিকে জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধিরা বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এ উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সেজন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন।
৩ ডিসেম্বর রাত ১টায় বিমান হামলা শুরু করে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বিমান বাহিনী। ভারতীয় বিমানবাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই একদিনেই তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় ২৩২ বারে মোট ৫০ টন বোমাবর্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সিলেট সেক্টরে বোমাবর্ষণ করে শত্রুর পাঁচটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। জামালপুর বিমান হামলায় হানাদার বাহিনীর কয়েকশ’ সৈন্য নিহত হয়, বিধ্বস্ত হয় বহু সামরিক যানবাহন। এদিন চট্টগ্রামে পাকিস্তান নৌবাহিনী ও যৌথ নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলোর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। বখশীগঞ্জে যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। মুক্ত হয় পীরগঞ্জ, হাতিবান্ধা, পচাগড়, বোদা, ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ। আর জীবননগর, দর্শনা ও কোট চাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে।
একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর পুর্ব পাকিস্তানের জনগণকে খুশি করার জন্য ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী ও জুলফিকার আলীকে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু ততদিনে বাঙালি জাতি ইয়াহিয়ার চাল বুঝে গিয়েছিল।
এদিকে পাকিস্তানের সাবমেরিন ‘গাজী’ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক সফল আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। একাত্তরের আজকের দিনে মুক্ত হয় আখাউড়া। এছাড়া নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সব নিরপেক্ষ জাহাজকে বন্দর ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। সেদিনই লেফটেনেন্ট আরেফিনের নেতৃত্বে বেশ বড় ধরণের অভিযান পরিচালিত হয়। দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি কর্ণেল এম এ জি ওসমানী বেতারে ভাষণ দেন একাত্তরের আজকের এই দিনে।