আজ অমর একুশে

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০৩

জাগরণীয়া ডেস্ক

আজ অমর ২১ ফেব্রুয়ারি। জাতির জীবনে অবিস্মরণীয় ও চিরভাস্বর দিন আজ। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর জব্বাররা। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা বাংলা। মূলত সেদিনই বপন হয়েছিল বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের বীজ যা চূড়ান্ত পরিনতি লাভ করে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীক। 

রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ এই দিনে সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে পালন করে মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই ভাষা শহীদদের স্মরণে সকলের কণ্ঠে বাজে একুশের অমর শোকসঙ্গীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…।’

একুশের চেতনা পৃথিবীর বুকে আমাদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ চিরকালের এ শ্লোগান তাই আজও সমহিমায় ভাস্বর। একুশ মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যাবতীয় গোঁড়ামি আর সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে শুভবোধের অঙ্গীকার। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি বসন্তের বাতাস ও পলাশ রঙে রাঙানো প্রভাতের সূর্য অমিত সম্ভাবনার যে স্বপ্ন, যে প্রত্যয় জাতির হৃদয়ে বপন হয়েছিল, সেই তেজোদীপ্ত বিদ্রোহের সুর আজো প্রতিটি ক্রান্তিকালে ধ্বনিত হয় বাঙালির হৃদয়ে। একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে, খালি পায়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই শামিল হতে শুরু করেছেন শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশের স্কুল-কলেজ, জেলা ও থানা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ।

আজ সরকারি ছুটির দিন। অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা। একই সঙ্গে সর্বত্র উড়বে শোকের পতীক, কালো পতাকা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত হবে মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্র ও অনুষ্ঠানমালা। মাতৃভাষার মর্যাদা রাখতে বুকের রক্ত ঢেলে বাঙালি যে ইতিহাস রচনা করেছিল, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্ব তাকে বরণ করেছে সুগভীর শ্রদ্ধায়। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বিশ্বের সকল জাতিসত্তার ভাষা রক্ষায় জাতিসংঘ বেছে নেয় আমাদের এই দিনটিকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মান রক্ষায় যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ১৯৯৯ সালে আজকের দিনটিকে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করতে যাচ্ছি।’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রদেশের ভাষা কী হবে, তা প্রদেশবাসীই স্থির করবেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। একাধিক রাষ্ট্রভাষা থাকলে কোন দেশ শক্তিশালী হতে পারে না।’ খাজা নাজিমুদ্দিনের এই  বক্তব্যই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দাবানল সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এর প্রতিবাদে ৩১ জানুয়ারি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা ভাষার প্রচলনের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করেন। আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু আন্দোলনে বাধা দিতে শেষ মুহূর্তে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। এতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য পিছিয়ে গেলেও ছাত্রদের দৃঢ়তায় ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা অনেকে শহিদ হন। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশজুড়ে। ছাত্রদের প্রবল প্রত্যাশার মুখে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের হিসাব-নিকাশের রাজনীতি উড়ে গিয়েছিল সেদিন। রক্তের বিনিময়ে বাঙালি ফিরিয়ে এনেছে তার মায়ের ভাষার সম্মান। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাংলাদেশের, বাঙালির চির প্রেরণার প্রতীক।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্যসাধারণ অর্জন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত