ময়মনসিংহে গারো সম্প্রদায় এগিয়ে যাচ্ছে
প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০১৬, ০২:৪২
ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা, ভালুকা, ফুলবাড়িয়া, ফুলপুর, হালুয়াঘাট, জামালপুর ও শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী, নকলা, নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি, বখশিগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল, মধুপুর, নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দায় গারোদের বসবাস। নবম-দশম শতাব্দিতে বাংলাদেশে গারো পাহাড়ের পাদদেশে সমতল ভূমিতে এদের বসতি স্থাপনের কথা ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুরে গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিবরণে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে যারা পাহাড়ে বাস করে, তারা ‘আচিক’ নামে পরিচিত। ‘আচিক’ মানে খাঁটি মানুষ। আর যারা সমতল ভূমিতে বাস করে তারা ‘মান্দি’ নামে পরিচিত। ‘মান্দি’ মানে মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন, কারিতাস ও স্থানীয় জেএনডিপি নামের বেসরকারি সংস্থার কল্যাণে গারোরা এখন উচ্চ শিক্ষা নেবার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এখন তাদের পদচারণা। ভাল চাকরিও করছে তারা। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার দুল্লা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড থেকে মেম্বার পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন গারো নারী কমলা ম্রং।
এর পরও রয়েছে তাদের অভাব-অনটন। তাদের জীবন-যাত্রার মান বা অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাদের জায়গাজমি নিয়ে নানান ঝামেলা। ময়মনসিংহে আদিবাসীদের নিয়ে প্রতি বছর সভা-সমাবেশ হয়। তাদের সমস্যা সরকারের নিকট তুলে ধরেন। কিন্তু এর সমাধান হচ্ছে না বলে আদিবাসীরা অভিযোগ করেন।
জানা গেছে, এমন অনেক আদিবাসী আছে, যারা বংশপরম্পরায় এলাকায় বসবাস করে আসছে। কিন্তু তাদের জমির দলিলপত্র নেই। আর এতেই হয়েছে যত ঝামেলা। এদের উচ্ছেদের জন্য কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি উঠে পড়ে লেগেছে। আদিবাসীদের মধ্যে অনেকের এখন ধারণা আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর কারণে বর্তমান আধুনিক জীবনের সাথে তাল মেলানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তারা এখন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়তে চায়।
আদিবাসীদের অনেক ভূ-সম্পত্তি ইতিমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। তাদের ক্ষোভ ভূ-সম্পত্তি বেহাত হওয়ার অন্যতম কারণ পক্ষপাতমূলক মাতৃতান্ত্রিক সম্পত্তি প্রথা। এই প্রথার বিরুদ্ধে এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে আদালতে আদিবাসীরা মামলা করেছিল। সেই মামলায় যে রায় দিয়েছিল তা হলো, নিজের পরিশ্রমের দ্বারা উপার্জিত সম্পত্তির উপর গারো পুরুষদের অধিকার আছে। এক সময় গারোদের মধ্যে অবাধ যৌন সম্পর্ক এবং যুথ বিবাহ প্রচলিত ছিল। এছাড়া বহিরাক্রমণ এবং বন্য জীব-জন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য নারী-পুরুষরা এক সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত করতো। যুদ্ধকালীন সময়ে সন্তান ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব থাকতো বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীর উপর।
আর এ থেকেই গারো সমাজে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। নারী পরম্পরায় গারোদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারিত হতে থাকে। সম্পত্তি শুধু মেয়েদের, পুরুষদের উত্তরাধিকার বলতে কিছুই নেই। তবে পরিবারের সকল কন্যা সম্পত্তির অংশীদার হয় না। গৃহকর্ত্রী বা তার মাচং (নিজ গোষ্ঠী) কর্তৃক নির্বাচিত একজন কন্যাই সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। এ নির্বাচিতা কন্যাকে গারো ভাষায় নকনা বলা হয়। সাধারণতঃ পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যাকেই নকনা নির্বাচিত করা হয়। নকনার জন্য পিতার আপন ভাগ্নেকে জামাই হিসেবে আনা হয়। এই জামাইকে গারো ভাষায় নকরম বলা হয়। যদি পিতার ভাগ্নে না থাকে তবে পিতার মাচং থেকে অন্য কোন ছেলেকে এনে নকরম বানানো হয়।
জানা যায়, গারো ভাষা বা মান্দি ভাষা একটি চীনা-তিব্বতি ভাষা। এটি ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্যের গারো পাহাড় এলাকার অধিবাসীদের প্রধান ভাষা। এটি বাংলাদেশ তথা মুক্তাগাছাতেও প্রচলিত। গারোরা তাদের ভাষা ধরে রাখলেও হারিয়ে ফেলেছে গারো ভাষা লাতিন লিপি।