উয়ারী-বটেশ্বর

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৭, ১৭:১৫

মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

বাংলাদেশের ইতিহাসের শেকড় প্রোথিত রয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরে। উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। ঐতিহাসিকদের ধারণা এবং সম্প্রতি উয়ারি-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত প্রত্ন নিদর্শন থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলে মানব বসতি শুরু হয়েছিল নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা কালে। উয়ারি-বটেশ্বরের ভূমিরূপগত প্রত্নতত্ত্বের প্রাথমিক সমীক্ষা, যা বিশুদ্ধভাবে অ্যান্টিকুইরিয়ান পদ্ধতি অবলম্বন করে অতীত বসতি-বিন্যাস ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে। উয়ারি-বটেশ্বরে পাওয়া হাতিয়ারকে পুরাপ্রস্তর ও নব্যপ্রস্তর যুগের বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। 

তবে সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বর উৎখননে তাম্র-প্রস্তর যুগের সুস্পষ্ট নিদর্শন, মাটিতে গর্ত করে মানুষের বসবাসের ঘর এবং কালো মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে তাম্র-প্রস্তর যুগেও এখানে মানববসতি ছিল। এ অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক ফসিল, কাঠের তৈরি প্রাগৈতিহাসিক বাটালি, হাত-কুঠার প্রভৃতি পাওয়া গেছে। হাতিয়ারগুলোর ধরন ও আকৃতি দেখে অনুমান করা যায় যে নব্যপ্রস্তর যুগে উয়ারি-বটেশ্বরে প্রথম মানববসতি গড়ে উঠেছিল।

দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত এ প্রত্নস্থান থেকে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যসুত্র-প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার, জনপদ, নগরায়ন, বাণিজ্য, প্রযুক্তি, স্থাপত্য, অলঙ্কার, মুদ্রা, দর্শন ও শিল্পকলার নিদর্শন। উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য তাৎপর্য মণ্ডিত প্রত্ন-ভাণ্ডার। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি নদী বন্দর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। মনে করা হচ্ছে, টলেমী বর্ণীত সৌনাগড়াই উয়ারী-বটেশ্বর। ভারতীয় উপমহাদেশের আদি-ঐতিহাসিক কালের অনেক নগর এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল উয়ারী-বটেশ্বরের। ২৩০০ বছরের প্রাচীন ৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সিল্ক রুটের সঙ্গেও যে উয়ারী-বটেশ্বর সংযুক্ত ছিল, নানা নিদর্শনগত প্রমাণ থেকে সম্প্রতি তা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলাদেশে সভ্যতার আদিকাল থেকেই অঞ্চলটিতে লোকবসতি শুরু হয়েছিল। প্রাক বৌদ্ধ যুগে মহেশ্বরদী পরগনা ও পার্শ্ববর্তী অনেক পরগনা ডোবা, নালা ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। লোকবসতি ছিল অতি বিরল। মাঝে মাঝে কিবাত, টিপরাই, ডোয়াই, কাবারু, গারো প্রভৃতি অনার্য জাতির আবাস ছিল।

বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশে মানব বসতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এবং একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট সংস্কৃতি হিসেবে টিকেও ছিল যুগে যুগে। ভূতত্ত্ববিদ-পুরাতত্ত্ববিদ-নৃবিজ্ঞানী গবেষক পণ্ডিতবর্গের মতানুযায়ী হিমযুগের পর থেকেই এতদঞ্চলের অবস্থান।

উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ৫০টি প্রত্নস্থান থেকে আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথর ও প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম- কাঠের হাতিয়ার, তাম্র- প্রস্তর সংস্কৃতির গর্ত- বসতি এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন করে লেখার তাৎপর্যপূর্ণ সব প্রত্নবস্তু। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম মহা জনপদ। দুর্গ-নগরটি ছিল সেই মহা জনপদের রাজধানী। এটি গড়ে উঠেছিল সুপরিকল্পিতভাবে। ইতোমধ্যে এখান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির দুর্গ-প্রাচীর, পরিখা, পাকা রাস্তা, পার্শ্ব রাস্তাসহ ইট নির্মিত অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন।

সম্প্রতি উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ-নগরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গেছে গর্ত-বসতি, চুলা, কূপ এবং এরই সঙ্গে পাওয়া গেছে কৃষ্ণ এবং রক্তিম মৃৎপাত্র। এ ছাড়া গর্ত বসতির মধ্যে পাওয়া গেছে মানব- ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের প্রস্তরখণ্ড। এ সবই উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলে নগর-পূর্ব তাম্র-প্রস্তর যুগে গ্রামীণ বসতির প্রমাণ। উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলের মানুষের পরিমাপ বিষয়ক জ্ঞান ছিল। জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতি বিষয়ক ধারনাও তাদের ছিল। এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ও খননের ফলে জেসপার, গ্রানাইট, ক্রিস্টাল, অন্যান্য পাথর ও পোড়ামাটির বাটখারা আবিষ্কৃত হয়েছে। উয়ারী বটেশ্বর ছিল একটি বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে গড়ে উঠেছিল পুতি তৈরির কারখানা এবং সম্ভবত এগুলো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হতো।

উয়ারী বটেশ্বর ছিল একটি নগর। উয়ারী বটেশ্বরে পাওয়া গেছে অসংখ্য ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। ব্যবসায়- বাণিজ্য প্রভৃতি বাস্তব প্রয়োজনে প্রাচীন যুগে উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলে নির্দিষ্ট মানের বাটখারার প্রয়োজন ছিল ; বাটখারাগুলোর সম্পর্কে ধারণা করা যায় যে এগুলোর কিছুসংখ্যক হয়তো পুঁতি পরিমাপের কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জেস্পার, গ্রানাইট, ক্রিস্টাল প্রভৃতি পাথরের বিভিন্ন পরিমাপের বাটখারার ব্যবহার উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলে একটি উন্নত সভ্যতার পরিচয় বহন করে।

নরসিংদী অঞ্চলে উপমহাদেশের প্রাচীনতম মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতি বিকশিত হয়েছিল এবং অত্র এলাকা যে একটি সমৃদ্ধ নগর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল উয়ারী বটেশ্বরে আবিষ্কৃত ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা বাটখারাসহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এর জ্বলন্ত প্রমাণ। আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উয়ারী বটেশ্বর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র। এটি একটি নদীবন্দরও ছিল। স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতি ও রোলেটেড মৃৎপাত্রের ভিত্তিতে বলা যায়, উয়ারী বটেশ্বরের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।

কারো কারো মতে প্রাগৈতিহাসিক শিকারি মানুষের কৃষি জীবনে উত্তরণ ঘটেছিল বাংলাদেশের এই অঞ্চলেই। সুসংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠার সময় থেকে এ অঞ্চল একটি প্রধান অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে মুখ্য অবদান রেখে আসছে এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। নরসিংদীর রয়েছে আড়াই হাজার বছরের পুরনো বস্ত্রশিল্পের সোনালি ইতিহাস যা সমগ্র পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে আজও এক কিংবদন্তী হয়ে আছে। সুবর্ণ গ্রামের সুতি বস্ত্র ভারতের মথুরা, বানারসীও উজ্জয়িনীর তৈরি মিহি বস্ত্রের চেয়ে আরও উৎকর্ষ বলে সারা বিশ্বে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

নরসিংদী জেলায় আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদের উপর ভিত্তি করে একটা স্পষ্ট ধারনা করা সম্ভব যে, খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার বছর পূর্বে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আদিম মানুষেরা গোষ্ঠীবদ্ধ স্থায়ী সমাজজীবন আরম্ভ করেছিল আর সে সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছিল নরসিংদী জেলার উত্তরাঞ্চলের গৈরিক উচ্চ ভূমিতে। নরসিংদী জেলার লালমাটির কঙ্করময় ভূখণ্ড আড়িয়াল খাঁ ও পাহাড়িয়া নদীর তীরবর্তী জনবসতিগুলোয় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন জনজীবনের অনেকগুলো নিদর্শন। এসব নিদর্শনের ভিত্তিতে এ অঞ্চলের জনবসতির বয়স নির্ণয় করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব দশহাজার থেকে এক লক্ষ বছর আগের।

এ অঞ্চলে প্রাপ্ত সমস্ত প্রত্ন নিদর্শন বিশ্লেষণ করলে প্রত্ন প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ, আদি ঐতিহাসিক যুগ এবং ঐতিহাসিক যুগে এ অঞ্চলে জন বসতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র
• মহেশ্বরদীর ইতিহাস, মূল- অধ্যাপক সুরেন্দ্র মোহন পঞ্চতীর্থ সম্পাদক- সরকার আবুল কালাম, নিখিল প্রকাশনা, ঢাকা ৷
• উয়ারী- বটেশ্বর শেকড়ের সন্ধানে- সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান, প্রথমা, জানুয়ারি, ২০১২ 
• উয়ারি-বটেশ্বর- শফিকুল আসগর দৈনিক বাংলা, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ 
• প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উয়ারি-বটেশ্বর, মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ-পাঠান