চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
প্রকাশ | ১৫ মে ২০১৭, ১৮:১৬ | আপডেট: ১৫ মে ২০১৭, ১৮:৩৮
চিকুনগুনিয়া (Chikungunya) হচ্ছে চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত ভাইরাসজনিত একটি রোগ। আমাদের অতি পরিচিত ডেঙ্গুর সঙ্গে এর বেশ কিছুটা মিল রয়েছে। ডেঙ্গুর মতোই এ ভাইরাসটিও এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস অ্যালবপ্টিকাস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গুর মতই মানবদেহ থেকে মশা এবং মশা থেকে মানবদেহে ছড়িয়ে থাকে। মানুষ ছাড়াও বানর, পাখি এবং ইঁদুরে এ ভাইরাসের জীবনচক্র বিদ্যমান।
অনেকের ভাইরাস জ্বর বা ডেঙ্গু জ্বর হয়ে সেরে যাওয়ার পরও দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে শরীর ভাল যাচ্ছে না। সাধারণত যে কোনো ভাইরাস কিংবা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। অথচ দেখা যাচ্ছে জ্বর সেরে গেলেও রোগী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ও দুর্বলবোধ করছেন, বিশেষ করে শরীরের বিভিন্ন গিটে গিটে ব্যথা, দুর্বলতা এবং ক্লান্তি খুব ভোগাচ্ছে। এসকল ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হিসেবে সন্দেহ করা হলেও এ রোগটি সম্ভবত ডেঙ্গু নয়, বরং এটি চিকুনগুনিয়া নামক একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পরবর্তী দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা শুরু হয়, যা কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। এই রোগে মৃত্যু ঝুঁকি প্রতি দশ হাজারে এক জন বা এর চেয়েও কম অর্থাৎ মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগের জটিলতা তুলনামূলক একটু বেশি হতে পারে। এই রোগ প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ ও ঘুমানোর সময় মশারি টাঙানো ইত্যাদি বিষয়ে সাবধান হতে হবে।
চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ
সাধারণ জ্বর বা ডেঙ্গু জ্বরের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়া একটু ভিন্ন রকম হয়। সাধারনত মশা কামড়ানোর ৩ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এই জ্বরের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও, কোনো উপসর্গই প্রকাশ পায় না। এ রোগটি সাধারণত আকস্মিক জ্বর, অস্থিসন্ধির ব্যথার মাধ্যমে শুরু হয়। নিম্নে চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ বা উপসর্গগুলি বর্ণনা করা হল-
=> চিকুনগুনিয়ার প্রথম লক্ষণই হল হঠাৎ করে উচ্চমাত্রার জ্বর আসা। আবার জ্বর চট করে ছাড়তেও চায় না। সাধারণত জ্বরের প্রচলিত ওষুধে অনেক সময় কোনও কাজই হয় না। এ জ্বর অনেকটা ডেঙ্গু জ্বরের মতোই। দেহের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে প্রায় ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। এ জ্বরে কোন কাঁপুনি বা ঘাম হয় না। জ্বর সাধারণত ২ থেকে ৫ দিন থাকতে পারে, এরপর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এরকম লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
=> চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে গাঁটের ব্যথা শুরু হয় । প্রথমে হাত এবং পা দিয়ে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে সারা শরীরে ব্যথা অনুভূত হতে শুরু করে। ব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকার ফলে শারীরিক দুর্বলতাও বাড়তে থাকে।
=> চিকুনগুনিয়া জ্বরের ফলে গাঁটের ব্যাথার পাশাপাশি পেশীর ব্যথার সমস্যাও দেখা যায়। অনেক সময় পেশী এতটাই শক্ত হয়ে যায় যে চলাফেরার সমস্যা শুরু হয় এবং ব্যাথা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, এমনকি ফুলেও যেতে পারে। পেশিতে ব্যথা কিংবা অস্থিসন্ধির ব্যথা জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে যা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক কাজ করতে বাধা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যথা এতই বেশি হয় যে, রোগীর হাঁটতে কষ্ট হয় কিংবা সামনের দিকে বেকে হাঁটে।
=> রোগের শুরুতেই ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে রোগ শুরু হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পর জ্বর কমতে শুরু করলে ফুসকুড়ির আবির্ভাব হতে পারে।
অনিদ্রা হতে পারে।
=> গায়ে লাল লাল দানার মতো র্যাশ দেখা যেতে পারে।
=> কনজাংটিভাইটিস হতে পারে।
=> চিকুনগুনিয়া জ্বরে অসহ্য মাথা ব্যথা হতে পারে। এই জ্বরে দীর্ঘসময় ধরে মাথা ব্যথার প্রভাব থাকতে পারে যা শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়ার পাশাপাশি ঘুমের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ব্যঘাত ঘটায়।
=> এই জ্বর হলে শরীর অনেক দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারনে বার বার বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
=> জ্বর এবং ব্যথায় কাতর হয়ে অনেকের মধ্যে অবসাদের প্রভাব দেখা যেতে পারে। ফলে কোন কাজেই মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না।
=> অনেক ক্ষেত্রে চোখ লাল হয়ে যাওয়া বা চোখের মধ্যে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। আবার অনেক সময় চোখের ব্যথা এতটাই বেড়ে যায় যে আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হয় এবং চোখ জ্বালা করে।
=> সাধারণত বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হয় এবং উপসর্গগুলো বেশিদিন থাকে।
=> ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে জ্বর ভালো হয়ে গেলে কয়েকদিন দুর্বলতা বা ক্লান্তি লাগতে পারে কিন্তু সাধারণত এত দীর্ঘ সময় ধরে শরীর ব্যথা বা অন্য লক্ষণগুলো থাকে না।
=> আবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হয়, যা অনেক সময় খুব ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু চিকুনগুনিয়া রোগে ডেঙ্গু জ্বরের মতো রক্তক্ষরণ হয় না এবং রক্তের প্লাটিলেট খুব বেশি হ্রাস পায় না।
রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা বিশেষ করে ভাইরাস পৃথকীকরণ, RT-PCR কিংবা সেরোলজির মাধ্যমে এ রোগ শনাক্ত করা যেতে পারে। রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এন্টিবডি দেখে এ রোগ সনাক্ত করা যেতে পারে। এতে অনেক ক্ষেত্রে ২ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
চিকিৎসা
চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলোকে নিরাময়ের মাধ্যমে করতে হয়। এ রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই এবং কোন টিকাও এখনও পর্যন্ত আবিস্কার হয়নি। এ রোগে আক্রান্ত রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য সাধারন প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে পানি দিয়ে শরীর মুছে দেয়া যেতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথার ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। নিজে নিজে কোন ওষুধ না খাওয়াই ভাল।
রোগীকে যেন মশা না কামড়ায় এ জন্য রোগীকে অবশ্যই মশারির ভেতরে রাখতে হবে। কারণ- আক্রান্ত রোগীকে কামড় দিয়ে, পরবর্তীতে কোনো সুস্থ লোককে সেই মশা কামড় দিলে ওই ব্যক্তিও এ রোগে আক্রান্ত হবেন।
প্রতিরোধ
চিকুনগুনিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো টিকা এখনও পর্যন্ত আবিস্কার হয়নি। এটি যেহেতু এডিস মশাবাহিত রোগ, তাই মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারে। যেমন- ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, লম্বা হাতাযুক্ত জামা ও ট্রাউজার পরে থাকা, বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে না দেয়া ইত্যাদি। শুধু স্ত্রী জাতীয় এডিস মশা দিনের বেলা কামড়ায়। আবার এরা একবারে একের অধিক ব্যক্তিকে কামড়াতে পছন্দ করে। তাই দিনে ঘুমালেও অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। এ মশার ডিম পানিতে এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। বালতি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার প্রভৃতি স্থানে অল্প পরিমাণ জমে থাকা পানিও ডিম পরিস্ফুটনের জন্য যথেষ্ট। যেহেতু এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে তাই যেন বাড়ির আশেপাশে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
পরিশেষে
ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত চারবার পর্যন্ত হতে পারে। অপরদিকে চিকুনগুনিয়া একবার হলে সাধারণত আর হয় না। এছাড়া অনেক বিষয়েই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এ রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ। এজন্য এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা এবং মশা নির্মূল করার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। সাবধানতাই একমাত্র এই রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। এ রোগে মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা প্রাত্যহিক জীবনে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই এ রোগ হয়েছে সন্দেহ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।