ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের সমস্যা ও সমাধান
প্রকাশ | ২২ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৫৫ | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:২৭
আমাদের শরীরের অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ ‘পা’। পা ছাড়া মানুষ অচল। তাই সব সময় পায়ের যত্ন নিতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের আরোও বেশি যত্ন নিতে হবে। কেন, কিভাবে আপনি আপনার পায়ের যত্ন নিবেন সেটি জানতে হবে।
‘ডায়াবেটিক পা’ (Diabetic Foot) একটি ডায়াবেটিস রোগ জনিত পায়ের রক্তনালীর জটিলতা। ১৫% ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এই জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পৃথিবীতে যত রোগীর পা কাটা লাগে তার মধ্যে ৮৪% হল ডায়াবেটিক পা। ডায়াবেটিস রোগীর পায়ে আঘাত লাগলে বা ক্ষত হলে সেখানে ক্ষুদ্র রক্তনালীর বিকাশ, এক্সট্রাসেলুলার ম্যাট্রিক্স, ত্বক ইত্যাদির বৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে হয়। ফলে ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয় এবং ক্ষত শুকাতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে জীবানু সংক্রমনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানে দুর্গন্ধযুক্ত পচন (গ্যাংগ্রিন) ধরে যায়। রোগীর জীবন রক্ষার্থে অনেক সময় পা বা পায়ের কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হয়।
প্রতিরোধ: প্রথমত ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত পায়ের যত্ন নিতে হবে, সব সময় পা পরিস্কার ও শুকনা রাখতে হবে, ডায়াবেটিক মোজা এবং জুতা ব্যবহার করতে হবে। পায়ে যাতে কোনও আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ঘরে বাইরে কোথাও খালি পায়ে হাঁটা যাবে না।
ঝুঁকি উপাদান: ডায়াবেটিস রোগীর পায়ে ক্ষত তৈরিতে প্রধান কারণগুলো হল- ১. ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথী ২. কম রক্ত চলাচল ও ৩. জীবানু সংক্রমনের সম্ভাবনা। ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথী হল পায়ে ব্যাথার অনুভূতি কমে যাওয়া বা অসারতা। এর ফলে রোগী পায়ে আঘাত পেলেও ব্যাথা অনুভব করেন না, ফলে পা কেটে গেলে বা পায়ে ফোস্কা পড়লেও তিনি তা বুঝতে পারেন না। সাধারনত পায়ের পাতা, পায়ের আঙ্গুল, গোড়ালি ও মেটা-টারসো ফ্যালানজিয়াল জয়েন্টে (পায়ের আঙ্গুলের জোড়া) ক্ষত সৃষ্টি হয়। ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের রক্তনালীতে এথেরোসেক্লরোটিক প্লাক (চর্বি জাতীয় বা রক্তের অন্যান্য জমাট ময়লা) জমে রক্তনালীর ভিতরটা সংকুচিত হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে ক্ষতস্থানে পুষ্টি ও রক্তের জীবানুরোধক উপাদানগুলো পর্যাপ্ত পরিমানে পৌঁছাতে পারে না। অবশেষে সেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে, যেখান থেকে পায়ে গ্যাংগ্রীন দেখা দিতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ পা: (নিচের এক বা একাধিক কারণ থাকলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ পা হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাধারনতঃ ঝুঁকিপূর্ণ পায়েই ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা দেখা দেয়) পায়ে পূর্বের কোনও ক্ষত বা পায়ের কোনও অংশের অঙ্গচ্ছেদ থাকলে। মোটা নখ, পায়ের হাড়ের জোড়ার সীমিত নড়াচড়া, হাড়ের অঙ্গবিকৃতি থাকলে। পায়ে জীবাণুর সংক্রমন বা অন্যান্য সমস্যা যেমন- লাল চাকা, গরম হওয়া, কড়া পরা বা কড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা থাকলে। পায়ের বিভিন্ন রক্তনালীর পালস বা ধমনীর গতি না পাওয়া গেলে। পায়ের স্পর্শ অনুভূতি না থাকলে। পায়ের তাপ অনুভূতি না থাকলে। পায়ের কম্পন অনুভূতি না থাকলে। এছাড়াও পায়ের অঙ্গবিকৃতির কারণেও পা ঝুঁকিপূর্ণ হয়। যেমন- পায়ের কোনও আঙ্গুলের সামনের অংশ নিচের দিকে বেঁকে থাকা (Claw toes) পায়ের মেটা-টারসাল হাড় (পায়ের আঙ্গুলের গোড়ার পিছনের হাড়) উঁচু হয়ে থাকা, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বিতীয় আঙ্গুলের দিকে বেঁকে থাকা (Bunion), পায়ের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের গোড়া ফুলে লাল হয়ে থাকা (Bunionnette), পায়ের ছোট ছোট ওজনবাহী হাড়ের ক্ষয় জনিত পদবিকৃতি (Charcot joint ইত্যাদি। চিকিৎসা: সংক্রমন ছাড়া পায়ের ছোটখাটো ক্ষত থাকলে এন্টিসেপটিক সলিউশন, নিয়মিত ড্রেসিং ও পায়ের বিশ্রাম দিতে হবে। সংক্রমিত ক্ষত থাকলে তা চিকিৎসা কেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ওষুধ, জীবাণু মুক্ত গজ ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে ক্ষতস্থানের ড্রেসিং ও মৃত টিস্যু কেটে ফেলে দিতে হবে, পায়ের ক্ষত বেশি খারাপ হলে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট অংশ কেটে বাদ দিতে হবে। পায়ের উপর থেকে যে কোনও ধরণের চাপ কমাতে হবে। প্রয়োজন হলে ভাস্কুলার সার্জারী (পায়ের রক্ত নালীর অপারেশন) করাতে হবে। একই সাথে ডায়াবেটিস পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওজন কমাতে হবে। ডায়াবেটিক পা এর চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ইনসুলিন নিলে ক্ষত সাধারনত দ্রুত শুকায়।
লেখক: এমবিবিএস (সিইউ); পিজিটি (সার্জারী); সিসিডি (বারডেম); ইডিসি (বারডেম)
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি স্বীকৃত ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিক ফুট চিকিৎসক
সূত্র: ইত্তেফাক