হাঁটুর ব্যথা হলে
প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:১৩
বেশির ভাগ বয়স্ক লোকের হাঁটুতে ব্যথা অনুভূত হয়, যা তাদের জন্য মারাত্মক এক সমস্যা। অনেক সময় এর তীব্রতা এত বেশি হয় যে, ব্যথার কারণে তারা বিছানা থেকে উঠার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাঁটুর ক্ষয় হতে থাকে, যা অস্টিও আর্থারাইটিস নামে পরিচিত। মূলত এ কারণেই হাঁটুতে ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়া এই সমস্যা হতে উত্তরণের উপায় সম্পর্কেও অনেকে অবগত নয়। সঠিক ওষুধ সেবন, ফিজিওথেরাপি, জীবন ধারন পদ্ধতির পরিবর্তন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করা বা ব্যথা উপশম করা যায়।
বাংলাদেশে আনুমানিক প্রায় ১০ মিলিয়ন লোক অস্টিও আর্থারাইটিস এ ভুগছে। আক্রান্তদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৬৫ বছর বয়সের ঊধের্্ব প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে ২ জন অস্টিও আর্থারাইটিসে ভুগছে। তাছাড়া এই রোগে আক্রান্ত পুরুষদের অর্ধেকেরই বয়স ৬৫ বছরের ঊধের্্ব । এই রোগ হলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমস্যা কয়েকগুন বেড়ে যায়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হাঁটুর চারদিকের জয়েন্ট বা সন্ধির ক্ষয়জনিত কারণে সাধারণত অস্টিও আর্থারাইটিস হয়ে থাকে।
হাঁটু ছাড়াও শরীরের ভার বহনকারী অন্যান্য প্রধান জয়েন্ট যেমন কোমর ও গোড়ালীর গিঁট প্রভৃতি জায়গায়ও অস্টিও আর্থারাইটিস হতে পারে। এ ধরনের আর্থারাইটিস ধীরে ধীরে, অস্থি সদৃশ্য যে অংশ জয়েন্ট গঠনে সহায়তা করে তার ক্ষতি সাধন করে।
অস্টিও আর্থারাইটিস হলে হাড়ের মসৃণ পৃষ্ঠদেশ এবড়ো থেবড়ো হয়ে পড়ে এবং কোথাও কোথাও গহ্বরের সৃষ্টি হয়। হাড়ের এরূপ ক্ষয়সাধনের ফলেও স্বাভাবিক পৃষ্ঠ অমসৃণ হয়ে যাওয়ায় অস্থি সন্ধিতে ব্যথা অনুভূত হয়ে থাকে। এছাড়া কখনও কখনও উক্ত জায়গা ফুলে যেতে পারে। হাঁটুর স্বাভাবিক নড়াচড়া ব্যাহত হতে পারে, জয়েন্টের অভ্যন্তরে মড়মড় শব্দ হতে পারে, এমনকি অনেক সময় হাঁটু বেঁকেও যেতে পারে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ের ক্ষয়জনিত কারণ ছাড়াও অ্যাথলেটস, শ্রমিক এবং যারা অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রম করে, তাদের হাঁটুতে মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেস বা চাপ পড়ায় আর্থারাইটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। জয়েন্ট ইনজুরি বা সন্ধি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া বা ফ্যাকচার হওয়া প্রভৃতির সাথে আর্থারাইটিস সম্পর্ক যুক্ত এবং এর ফলে জয়েন্টের আভ্যন্তরীন টিসু্য বা কোষের ক্ষতি সাধিত হতে পারে। যে সকল ব্যক্তির কয়েকবার হাঁটুতে আঘাত পাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে বয়স বাড়লে তাদেরই অস্টিও আর্থারাইটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। উরুর মাংশপেশী যা হাঁটুর জয়েন্টকে সাপোর্ট দেয়, তা ব্যায়াম না করার কারণে দূর্বল হয়ে যেতে পারে এবং এর ফলে জয়েন্টে ব্যথা অনুভূত হওয়ার পাশাপাশি তা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। আবার, যে সমস্ত ব্যক্তির শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি তাদের অতিরিক্ত ওজনের কারণে হাঁটুতে মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ায় অস্টিও আর্থারাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত ব্যক্তি তরুণ বয়সে মাত্রাতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হন তাদেরও বয়সকালে আর্থারাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস করার সময় আমি প্রায়শই রোগীর যে প্রশ্নটির সম্মুখীন হই তা হলো, ''কখন এবং কিভাবে আমি বুঝব যে, আমার আর্থারাইটিস হয়েছে"। অনেক সময় দেখা যায় হাঁটুতে রসের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জায়গাটা ফুলে গেছে এবং এর কারণে খুড়িয়ে বা থেমে থেমে হাঁটতে হচ্ছে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে না পারা, আক্রান্ত হাঁটুর স্বাভাবিক গতি কমে যাওয়া বা হাঁটু স্বাভাবিক অবস্থায় যতটুকু বাঁকানো যায় তা করতে না পারা অথবা হাঁটু সম্পূর্ণ সোজা করতে পারার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলা, অবশেষে অবস্থা যখন খুব খারাপের দিকে যায় তখন প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হওয়া প্রভৃতিই এই রোগের উলেস্নখযোগ্য লক্ষণ। এছাড়া অন্যান্য প্রধান উপসর্গগুলো হলো, হাঁটুতে পুনঃপুনঃ ব্যথা অনুভূত হওয়া। হাঁটু কিছুক্ষণ নড়াচড়া বা সক্রিয় থাকার পর এর অবস্থা আরও শোচনীয় হওয়া। আবার একটানা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকলে হাঁটুর স্টিফনেস বা আড়ষ্টতা বেড়ে যাওয়া, তখন হাঁটু স্বাভাবিকের ন্যায় সোজা করা বা বাঁকানো যায় না। এছাড়া অতিরিক্ত কাজ করলে হাঁটু ফুলে যায় এবং অস্টিও আর্থারাইটিসের মাত্রা তীব্রতর হলে হাঁটু অনেক সময় ধনুকের মত বেঁকে যায়।
অস্টিও আর্থারাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগকেই ননসার্জিক্যাল চিকিৎসা যেমন ওষুধ সেবন, ফিজিওথেরাপি, জীবনযাপন প্রণালীর পরিবর্তন বা ইঞ্জেকশন প্রভৃতির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে যদি এতে ব্যথা নিরাময় না হয় তবে সেই ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসার বিষয় বিবেচনা করা হয়। সার্জিক্যাল পদ্ধতিগুলোর মধ্যে নতুন পদ্ধতি হলো আথ্রর্োস্কোপিক ওয়াশআউট, যার মাধ্যমে হাঁটুর ব্যথা মুক্ত করা সম্ভব। যখন ননসার্জিক্যাল বা আথ্রর্োস্কোপিক ওয়াশআউট পদ্ধতি উভয়ই ব্যর্থ হয় এবং হাঁটুতে ব্যথা ও অঙ্গবিকৃতি ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ হাঁটুর জয়েন্ট প্রতিস্থাপন বা টোটাল নী রিপেস্নসমেন্টই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি, যা বর্তমানে দেশের অত্যাধুনিক হাসপাতাল সমূহে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হাঁটু বা নী সার্জনদের তত্ত্বাবধানে করা সম্ভব।
লেখক: কনসালটেন্ট-এ্যাপোলো নী সেন্টার, এ্যাপোলো হসপিটালস ঢাকা