নারীর নীরব ঘাতক স্তন ক্যান্সার
প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৩৫ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৬, ০০:১৯
স্তন ক্যান্সারে নারীর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, তবে পুরুষও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে এ ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অধিক। স্তন ক্যান্সারে যতজন আক্রান্ত হয়, তাদের ৮০ ভাগেরই বয়স ৫০-এর ওপরে। সেই সঙ্গে যাদের পরিবারে কারও স্তন ক্যান্সার রয়েছে, তাদেরও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু নারী নয়; এরই মধ্যে অনেক পুরুষও এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মতে, স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতনতাই স্তন ক্যান্সার রুখতে পারে।
২০১৪ সালে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধিত ক্যান্সার রোগীদের নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এরপর আর এ জাতীয় কোনো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী নারী ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত, যা গাণিতিক হিসাবে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তদের গড় বয়স প্রায় ৪৩ বছর।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ থেকে দেখা যায়, সারাবিশ্বে অন্য যে কোনো রোগের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা শীর্ষে। বাংলাদেশেও কয়েক বছরের মধ্যে নারীর অসুস্থতায় এক নম্বরে উঠে এসেছে স্তন ক্যান্সার। আবার নারী-পুরুষ মিলিয়ে হিসাব করলেও স্তন ক্যান্সারের অবস্থান শীর্ষে। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর হারেও এ রোগ এক নম্বরে অবস্থান করছে। প্রতিবছর বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ১৪ হাজার ৮২২ জন। আর মারা যায় সাত হাজার ১৩৫ জন। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ২২ হাজার ৭১৫ নারী নতুন করে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ৯১ হাজার ৩৩৯ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্তন ক্যান্সারের বিভিন্ন ঝুঁকি বা 'রিস্ক ফ্যাক্টর' সম্পর্কে যদি মানুষকে সচেতন করা যায়, তাহলেই স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রাথমিকভাবে অনেক কিছু করা সম্ভব। কারণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ শনাক্ত করা। তারা বলছেন, সচেতনতার অভাবেই দেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া নারীদের চিকিৎসা বিলম্বিত হয়। সচেতনতার অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যান্সার দেরিতে ধরা পড়ে। যখন চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার আর তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকে না, তখন তারা চিকিৎসকের কাছে আসেন। বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
নারীর এ নীরব ঘাতক সম্পর্কে সচেতন করতে ১০ অক্টোবর (সোমবার) পালিত হচ্ছে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা দিবস। তবে বিশ্বজুড়ে অক্টোবর মাস স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস হিসেবে পালিত হয়। ১ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে। স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অক্টোবর জুড়ে নেওয়া হয়েছে নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি। এ উপলক্ষ্যে সোমবার সকাল ৯টায় শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে উপাচার্যের নেতৃত্বে গোলাপি সড়ক শোভাযাত্রা বের করা হয়।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, স্তন ক্যান্সার নারীর নীরব ঘাতক হিসেবে বিস্তার লাভ করছে। তবে বর্তমান সময়ে এটা শুধু নারীর রোগ হিসেবে নেই, পুরুষরাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে এরই মধ্যে অনেক পুরুষ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। পুরুষের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা এক ভাগ। তিনি বলেন, এ রোগের এখনও কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। সচেতনতাই স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে। স্তন ক্যান্সার নিয়ে বর্তমানে যে প্রচার চলছে তা যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে আরও জানাতে হবে। বিশেষ করে নারীদের তাদের সন্তানদের ব্রেস্ট ফিডিংয়ের বিষয়ে আরও বেশি সচেতন করতে হবে। কারণ যাদের মধ্যে সন্তানকে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর বিষয়ে আগ্রহ কম, তারাই প্রধানত স্তন ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া স্তন ক্যান্সারের জন্য ফরমালিনযুক্ত খাবার বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
স্তন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা মাত্রই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত এবং চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। আর নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে এ অসুখের লক্ষণ শনাক্ত করা সম্ভব। এ সময় চিকিৎসা করালে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। এতে শারীরিক কষ্ট এবং চিকিৎসা খরচ দুটিই কমে যায়।
বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, আমাদের দেশে সচেতনতার অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেক দেরিতে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে। এ কারণে চিকিৎসায় রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এ রোগের বিভিন্ন ঝুঁকির বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে পারলে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। যারা ক্যান্সার নিয়ে কাজ করেন, তাদেরও সচেতনতার বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে। সচেতনতাই পারে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরোধের কাজ করতে।
তিনি বলেন, ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সী নারীদের প্রতি তিন বছর পরপর ব্রেস্ট স্ক্রিনিং বা ম্যামোগ্রাম করানো উচিত। ম্যামোগ্রাম হচ্ছে এক্সরের মাধ্যমে নারীদের স্তনের অবস্থা পরীক্ষা করা। সাধারণত প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার এত ছোট থাকে যে, বাইরে থেকে সেটা বোঝা সম্ভব হয় না। কিন্তু ম্যামোগ্রামের মাধ্যমে খুব ছোট থাকা অবস্থাতে বা প্রাথমিক পর্যায়েই ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে ক্যান্সার থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক। এ পরীক্ষার জন্য মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে।
সূত্র: সমকাল