জলাতঙ্ক: অপরকে জানান, জীবন বাঁচান
প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৪০ | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:২৯
জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত মারাত্মক ও গুরুত্বপূর্ণ রোগ জলাতঙ্ক বাংলাদেশে প্রাদুর্ভাব হিসেবে বর্তমান। উচ্চমাত্রার জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি ও ক্ষতির দিক বিবেচনায় জলাতঙ্ক মৃত্যু হারের দিক থেকে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (WHO) প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০০০-২৫০০ মানুষ জলাতঙ্ক আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং তিন লক্ষাধিক মানুষ কামড় পরবর্তী প্রতিষেধক (PEP) গ্রহণ করে। জলাতঙ্ক পৃথিবীতে সবচেয়ে মারাত্মক রোগ। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রতি নয় মিনিটে একজন মানুষ জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এদের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষ বেশি। স্বাস্থ্যসেবা কিংবা প্রতিষেধক টিকা যেখানে মানুষের নাগালের বাইরে সেখানে এ সমস্যা আরো বেশি প্রকট। ২০১৫’র এক গবেষণা রিপোর্ট মতে জলাতঙ্ক এড়াতে প্রতিবছর বিশ্বের ২৯ মিলিয়ন মানুষ কামড় পরবর্তী প্রতিষেধক (PEP) গ্রহণ করে এবং নিম্নমানের জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা জনিত কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৬০ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। শুধু তাই নয়- জলাতঙ্ক আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ গবাদি প্রাণিও মারা যায়। জলাতঙ্ক প্রতিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি গ্লোব্যাল এলায়েন্স ফর র্যাবিস কন্ট্রোল (GARC) দ্বারা স্বীকৃত এবং ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জলাতঙ্ক সম্পর্কিত সকল পদক্ষেপ ও কাজ সন্নিবেশ ঘটিয়ে বছর জুড়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যাদি পূর্বাপর উপস্থাপনের মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। এবারের জলাতঙ্ক দিবসের প্রতিপাদ্য Rabies: Share the message. Save a life অর্থাৎ জলাতঙ্ক: অপরকে জানান, জীবন বাঁচান।
জলাতঙ্ক কি?
জলাতঙ্ক ভাইরাসজনিত একটি জ্যুনোটিক রোগ। জ্যুনোটিক মানে প্রাণি থেকে মানুষে ছড়ানো রোগ। এই রোগটি উষ্ণ-রক্তের স্তন্যপায়ী প্রাণি সাধারণত কুকুর থেকে মানুষে ছড়ায়। জলাতঙ্কগ্রস্থ প্রাণি দ্বারা আক্রান্তের পর কোন তাৎক্ষণিক প্রতিষেধক ও চিকিৎসা গ্রহণ না করলে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯৯.৯%।জলাতঙ্কের সঠিক চিকিৎসা এই মারাত্মক রোগের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
জলাতঙ্ক কিভাবে ছড়ায়?
জলাতঙ্ক সংক্রমণের একমাত্র উৎস সংক্রামক প্রাণির লালা। সরাসরি কামড়, আঁচড় বা অন্য কোন উপায়ে সংক্রামক প্রাণির লালা পোষক দেহে ছড়ালে জলাতঙ্ক হয়। মানুষে ৯৫% জলাতঙ্ক সংক্রমণ আক্রান্ত প্রাণি কুকুর থেকে আসে। অন্যান্য আক্রান্ত প্রাণির মধ্যে বিড়াল, বাদুড়, ভোঁদড়, শেয়াল ও নেকড়ে উল্লেখযোগ্য। আক্রান্ত প্রাণির লালা মানুষের চোখে প্রবেশ করে জলাতঙ্ক হতে পারে। তত্ত্বীয়ভাবে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও সঙ্গমের মাধ্যমে মানুষে জলাতঙ্ক ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। খরগোশ ও তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণি (rodent) যেমন ইঁদুর, মূষিক, কাঠবিড়াল প্রভৃতির মাধ্যমে জলাতঙ্ক হয় না।
জলাতঙ্কের লক্ষণগুলো কি কি?
আক্রান্ত প্রাণির কামড়, আঁচড় বা লেহনের দিন থেকে জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশের দিন পর্যন্ত সময়সীমাকে সংক্রমণ সময় বলা হয়। মানুষে সাধারণভাবে এই সময়সীমা ১-৩ মাস। তবে এই সময়সীমা এক সপ্তাহ’র কম কিংবা এক বছরের বেশিও হতে পারে। সাধারণভাবে কুকুর-বিড়ালে এই সময়সীমা ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাস। তবে এই সময়সীমা ১০ দিনের মধ্যে কিংবা ৬ মাসের বেশি হতে পারে। জাবর কাটা প্রাণিসমূহ যেমন গরু, ছাগল, মহিষ এ সাধারণভাবে এই সময়সীমা ২৫ দিন থেকে ৫ মাস।
জলাতঙ্কের প্রাথমিক দুটি লক্ষণ হচ্ছে জ্বর ও আক্রান্ত স্থানে অস্বাভাবিক ব্যথা, তীব্র জ্বালাপোড়া, খোঁচানি ও অস্থিরতা। আক্রান্তের স্থান ও তীব্রতার উপর নির্ভর করে জলাতঙ্কের লক্ষণ আগ্রাসী ও নিস্তেজ- এই দু’রকমের হয়ে থাকে।
জলাতঙ্ক হলে মানুষের মত প্রাণিতেও আচরণে পরিবর্তন আসবে। শান্ত প্রকৃতির প্রাণি ক্রুদ্ধ হবে কিংবা বেশ সক্রিয় প্রকৃতির প্রাণি চুপচাপ থাকবে। মানুষের মত প্রাণিতেও জলাতঙ্কের প্রাথমিক দুটি লক্ষণ হচ্ছে জ্বর ও আক্রান্ত স্থানে অস্বাভাবিক ব্যথা, তীব্র জ্বালাপোড়া, খোঁচানি ও অস্থিরতা।
মানুষে সৃষ্ট জলাতঙ্কের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
মাথাব্যথা, লালা নিঃসরণ, অতিরিক্ত ঘামানো, আলো ভীতি, পানি ভীতি, ক্রদ্ধ আচরণ, খিটখিটে মেজাজ, স্মৃতিভ্রম, কামড় বা আঁচড়ের দাগ থেকে ধীরে ধীরে আক্রান্ত স্থানের মাংস পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়া, কোমা, মৃত্যু।
সংক্রমণ সময়: ১-৩ মাস।
প্রাণিতে সৃষ্ট জলাতঙ্কের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
আক্রান্ত প্রাণি বিভ্রান্ত, অস্থির ও আক্রমণাত্মক দেখায়, অদ্ভুত আচরণ প্রকাশ যেমন বায়ু কামড়ানোর চেষ্টা করা, চক্রাকার বাঁক সৃষ্টি করা বা অপরিচিতদের দেখলে অস্বাভাবিক ভীতসন্ত্রস্থ হওয়া, কাছাকাছি যে কোন বস্তু আঘাত বা কামড়ানোর চেষ্টা করা, কণ্ঠ পরিবর্তন লক্ষণীয়, অত্যধিক ঢলে পড়বে, মাঝেমধ্যে অদ্ভুত জিনিস যেমন পাথর, ময়লা বা কাঠ খায়, ক্ষুধামন্দা, আংশিক বা সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া, অন্যান্য বাহ্যিক আচরণে পরিবর্তন।
সংক্রমণ সময়:
কুকুর: ২ সপ্তাহ-৩ মাস
গরু, ছাগল, মহিষ: ২৫ দিন-৫ মাস।
কোন ব্যক্তিতে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দিলে কি করতে হবে?
জলাতঙ্ক রোগ সংক্রমিত হওয়ার পর কোন তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণ না করলে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯৯.৯%। তাই কোন ব্যক্তিতে এই রোগের লক্ষণ দেখা যাওয়া মাত্রই অবিলম্বে তাকে নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির ভোগান্তি লাঘব হবে এবং তার পারিবারিক দুশ্চিন্তার চাপ কমবে।
কোন প্রাণিতে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দিলে কি করতে হবে?
কোন প্রাণিতে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দিলে ঐ প্রাণি থেকে মানুষকে যথাসম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ দিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেমন স্থানীয় ভেটেরিনারি কর্মকর্তা, স্থানীয় নেতা বা পুলিশকে বিষয়টি অবশ্যই অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা যদি না পাওয়া যায়; তখন একটি নিরাপদ পরিবেশে পর্যাপ্ত পানি ও খাবারের ব্যবস্থা রেখে সন্দেহজনক প্রাণিকে টানা ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পর্যবেক্ষণ সময় শেষে যদি ঐ প্রাণি দিব্যি বেঁচে থাকে; তবে ঐ প্রাণিতে জলাতঙ্ক হয় নি বলে ধরে নেওয়া যাবে।
জলাতঙ্ক প্রতিরোধে করণীয় কি?
জলাতঙ্ক আজও তাই বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। অথচ ভয়াবহ, মারাত্মক, দুরারোগ্য এই ব্যাধিটি শতভাগ নির্মূল (প্রতিরোধ) সম্ভব। মানুষ বা প্রাণিতে জলাতঙ্ক প্রতিকারের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা ও টেকসই সমাধান কুকুরে নিয়মিত জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান। তাত্ত্বিকভাবে কুকুরে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে এদের মোট সংখ্যার ৫০-৭০% টীকা দিতে হয়। টীকা না দেয়া কুকুর-বিড়ালে জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ নিশ্চিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে ইউথেনেশিয়া করতে হবে। এতে তাদের মালিকের অসম্মতি থাকলে কঠোরভাবে ৬ মাসের জন্য বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে এবং জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ না মিললেও ছেড়ে দেয়ার ১ মাস আগে টীকা দিতে হবে। প্রাথমিক লক্ষণ দেখে প্রাণিতে তথা কুকুরে জলাতঙ্ক হয়েছে বুঝা অনেক কঠিন ব্যাপার। তাই কুকুর দেখে আতংক হওয়া এবং কুকুরের কোন ক্ষতি করা একেবারেই অনুচিত। কিন্তু কুকুর হত্যা জলাতঙ্ক প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করে না। অথচ জলাতঙ্ক প্রতিরোধের নামে প্রতি বছর অমানবিকভাবে আনুমানিক বিশ মিলিয়ন কুকুর হত্যা করা হয়; যার খুব সামান্য প্রভাব এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে। জলাতঙ্কের প্রাথমিক চিকিৎসায় ক্ষত স্থানটি অবশ্যই অবশ্যই সাবান পানি দিয়ে ১০-১৫ মিনিট ধৌতকরণ বাঞ্ছনীয়। গবেষণায় দেখা গেছে- জলাতঙ্ক আক্রান্তের ৬০% ভুক্তভোগী'র কামড় ক্ষতটি সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয় নি। এ থেকে বোঝা যায়, ক্ষতস্থানে সাবান পানি'র ব্যবহার জলাতঙ্ক হবার সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে আনতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ গণশিক্ষা কার্যক্রম এবং যোগাযোগের মাধ্যমে উপযুক্ত গণসচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট, র্যাবিস ইন এশিয়া ফাউন্ডেশন-বাংলাদেশ।