ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক রাজিয়া
প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৭, ১৯:৫৩ | আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭, ২১:১২
মুসলিম ভারতের তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে (প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক) রাজিয়াই একমাত্র নারী, যিনি দিল্লির সিংহাসনে প্রথম উপবেশন এবং রাজদন্ড ধারণ করে প্রবল প্রতাপে শাসন করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিশ, যিনি দাস বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন।
রাজিয়া সুলতানা পৈতৃক সূত্রে তুর্কি বংশদ্ভুত ছিলেন। শৈশবেই রাজিয়া ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতি এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি পিতা সুলতান ইলতুৎমিশের শাসনকার্য লক্ষ করতেন। তিনি অস্ত্রচালনা, অশ্বারোহণ ও রাজনীতিতে ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন। রাজিয়ার রাজোচিত গুণাবলি দেখে সুলতান ইলতুৎমিশ তাঁর পুত্রদের পরিবর্তে তাঁর কন্যা রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনিত করেন। এ-ব্যাপারে সভাসদেরা আপত্তি জানালে তিনি তাঁদের লক্ষ করে বলেন, “আমার পুত্রেরা আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে, তাদের কোন দায়িত্ববোধ নেই। এ-কারনে আমার মৃত্যুর পর শাসন করার যোগ্যতা আমার কন্যার চেয়ে অন্য কারও বেশি নেই।
ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর নারীবিদ্বেষী আমির-ওমরাহগণ রাজিয়ার বিরোধিতা শুরু করেন। তাঁদের যুক্তি হল যে, ইলতুৎমিশের পুত্র থাকার কারনে কন্যা উত্তরাধিকারী হতে পারে না। উত্তরাধিকারসূত্রে জেষ্ঠ্য পুত্র সিংহাসনে স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু সুলতান ইলতুৎমিশ উইলে রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করায় তাঁর ভাইয়েরা কোন আপত্তি করতে পারেননি। কিন্তু নারী শাসনের বিরোধী আমির-ওমরাহগণ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। ফলে রাজিয়া তাঁর অধিকার ছেড়ে দেন। তাঁর সৎভাই রুকুনুদ্দিনকে সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রুকুনুদ্দিন রাজকার্যে অবহেলা করে বিলাসিতায় দিন যাপন করতে থাকেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে আমির-ওমরাহগণ রাজিয়াকে সুলতানা হিসেবে মেনে নিতে রাজি হলেন। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে রুকুনুদ্দিনের মা রাজিয়াকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। এই ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর সভাসদেরা রাজিয়া সুলতানার প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করেন।
১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজিয়া সুলতানা সিংহাসনে বসেন। রাজিয়া একজন বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসক ছিলেন। তাঁর সময়ে দাসবংশের শাসনকাল খুব সুদৃঢ় হয় এবং রাজ্যের সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করে। তার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি সাধিত হয়। তিনি যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেন। রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষ লাগানো হয় এবং পানি সরবরাহের জন্য অসংখ্য কুয়ো খনন করা হয়। তিনি সাহিত্যিক, শিল্পী ও কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার শাসনামলে সঙ্গীত ও চিত্রকলারও প্রভূত বিকাশ সাধিত হয়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি কবি ছিলেন এবং কুরআন পাঠ করতে পারতেন।
রাজিয়া সুলতানা অন্তঃপুরিকা ছিলেন না। তিনি প্রকাশ্য দরবারে রাজকীয় পোশাক পরিধান করে সিংহাসনে আরোহন করতেন। তিনি কোন ঘোমটা ব্যবহার করতেন না। পুরুষের বেশে তিনি আলখাল্লা এবং পাগড়ি পরে জনসম্মুখে আসতেন। তিনি সভাসদ, আমির-ওমরাহদের রাজ্য শাসন প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন এবং তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করে আইন বা নির্দেশ জারি করতেন। তিনি দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন এবং বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। দুর্ভাগ্যবশত রাজিয়া সুলতানার খোলামেলা রাজকীয় আচার-আচরণ রক্ষণশীল আমিরগণ মোটেই পছন্দ করতেন না। তিনি খুবই উদার ও জনদরদি শাসক ছিলেন। তিনি হিন্দুদের উপর অর্পিত বর্ধিত কর বিলোপ করেন; কিন্তু তাঁর এই পদক্ষেপ অনেক আমির মোটেও পছন্দ করেননি।
রাজিয়া সুলতানা জামালুদ্দিন ইয়াকুত নামের অতুর্কি বংশোদ্ভুত এক ব্যক্তিকে পছন্দ করতেন এবং তাঁকে আস্তাবলের প্রধান নিযুক্ত করেন। এই পদটি তুর্কি বংশোদ্ভূত কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট ছিল। ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, জামালুদ্দিনের প্রতি রাজিয়ার এমন দুর্বলতা ছিল যে, তিনি শাসনকার্য পরিচালনায় কেবলই তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। অনেকে তাকে রাজিয়া সুলতানান প্রেমিক বলে অভিহিত করেন। জামালুদ্দিন ইয়াকুতের প্রতি মাত্রাধিক দুর্বলতা ও তাঁকে অধিক সুযোগ-সুবিধা দানের জন্য আলতুনিয়া নামের একজন গভর্নর রাজিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। জামালুদ্দিনকে সাথে নিয়ে রাজিয়া সুলতানা অশ্বপৃষ্ঠে চেপে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু বিদ্রোহী দলে অধিকসংখ্যক সৈন্য জামালুদ্দিন ও রাজিয়া পরাজিত হন। জামালুদ্দিন যুদ্ধে নিহত হন এবং রাজিয়া আলতুনির হাতে বন্ধি হন। দিল্লিতে আমির-ওমরাহগণ রাজিয়ার এই বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়ে তার সৎভাইকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। এদিকে বন্ধি অবস্থায় রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিয়ে করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে নিজের এবং আলতুনিয়ার সৈন্যবাহিনীসহ রাজকীয় বাহিনী দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু দিল্লির উপকন্ঠে নতুন সুলতানের বাহিনীর সাথে আলতুনিয়া ও রাজিয়ার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে রাজিয়া পরাজিত ও নিহত হন। এজন্য রাজিয়াকে বীর রানী বলা যায়। দিল্লির উপকন্ঠে একটি সমাধি নির্মাণ করে সুলতানা রাজিয়াকে সমাহিত করা হয়।
রাজিয়া সুলতানার পতনের মূলে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। এগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সঠিক মন্তব্য ছিল এই যে, ‘Her sex was her worst enemy’ অর্থাৎ “তাঁর নারী হওয়াটাই ছিল তাঁর ঘোরতর শত্রু।” একথার অর্থ ছিল এই যে, যদি জামালুদ্দিন ইয়াকুতের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে না উঠত এবং একজন আস্থাবলের প্রধানকে বিয়ে করে তিনি মর্যাদাসম্পন্ন আমির-ওমরাহদের বিরাগভাজন না হতেন, তাহলে হয়তো তাঁর ভাগ্যবিপর্যয় হত না। পরে তাঁর বিদ্রোহী গভর্নর আলতুনিয়াকে বিয়ে করেও তিনি শেষরক্ষা করতে পারেননি।
রাজিয়া সুলতানার সমসাময়িক ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই সিরাজ তাঁর ‘তবকৎ-ই-নাসিরি’ গ্রন্থে বলেছেন, এই রাজমহীয়সী ছিলেন বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ন, দয়াশীল, সুবিচারক, বিদ্যোৎসাহী, প্রজাবৎসল, সমরকুশল এবং রাজোচিত অন্যান্য গুণের অধিকারী।