‘মোরা’র তাণ্ডবে কক্সবাজারে অর্ধলাখ বসতবাড়ি বিধ্বস্ত
প্রকাশ | ৩১ মে ২০১৭, ২০:১৯
জলোচ্ছ্বাসহীন তাণ্ডবলীলায় কক্সবাজারের প্রত্যন্ত অঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। প্রচণ্ড বেগে আঘাত হেনে উপকূল ছুঁয়ে বিদায় নিলেও রেখে গেছে চার ঘণ্টার তাণ্ডবের ব্যাপক ক্ষতির চিহ্ন। ‘মোরা’র এই তাণ্ডবলীলা কেড়ে নিয়েছে নারীসহ ৫ জনের প্রাণ।
মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে ঝড় থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে আসার পর আতংকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় এবং কক্সবাজার সদরে ঝড়ে গাছচাপায় মারা গেছেন আরো ৪ জন।
তারা হলেন- কক্সবাজার পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের ৬নং জেডিঘাট এলাকায় বদিউল আলমের স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৫৫) হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে, চকরিয়ার বড়ভেওলা এলাকার মৃত নূর আলম সিকদারের স্ত্রী সায়েরা খাতুন (৬৫), একই উপজেলার ডুলাহাজারা পূর্ব ডুমখালী এলাকার আবদুল জব্বারের ছেলে রহমত উল্লাহ (৫০), পেকুয়ার উজানটিয়া নতুনঘোনা পেকুয়ারচর এলাকার আজিজুর রহমানের ছেলে আবদুল হাকিম সওদাগর (৫৫) এবং সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়নের গজালিয়া গ্রামের শাহাজাহানের মেয়ে শাহিনা আকতার (১০) গাছ চাপা পড়ে মারা যায়।
এছাড়া ‘মোরা’র আঘাতে কক্সবাজারে প্রায় ৫৩ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে বিপুল পরিমাণ গাছপালা। ব্যাপকহারে বিদ্যুৎ খুঁটি ভেঙে পড়ায় পুরো কক্সবাজারে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বাড়িঘর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর এখনও উত্তাল রয়েছে। তবে মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে জেলার আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এ কারণে কক্সবাজারের ৫৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া তিন লক্ষাধিক মানুষ নিজেদের মতো করে ঘরে ফিরেছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে জেলার কুতুবদিয়ায় ৪ হাজার ২৭০টি বসত ঘর সম্পূর্ণ ও ৬ হাজার ৩৮২টি আংশিক, মহেশখালীতে ৫ হাজার ৪৮০টি সম্পূর্ণ ও ৮ হাজার ৭০০ আংশিক, পেকুয়ায় ২০০টি সম্পূর্ণ ও এক হাজার ১৫টি আংশিক, রামুতে ২৫২টি সম্পূর্ণ ও ১১৯৬টি আংশিক, উখিয়ায় ৫০টি সম্পূর্ণ ও ২০০টি আংশিক, সদরে ১৫০টি সম্পূর্ণ ও ৬০০ আংশিক, টেকনাফে ৪ হাজার ৫০০ সম্পূর্ণ ও ৬ হাজার আংশিক, চকরিয়ায় এক হাজার ১৯৩ সম্পূর্ণ ও এক হাজার ৩৫টি আংশিক, কক্সবাজার পৌরসভায় ৫৩৫ সম্পূর্ণ ও এক হাজার ৯২ আংশিক, টেকনাফ পৌরসভায় ১১৩ সম্পূর্ণ ও ২৬৭ আংশিক, চকরিয়া পৌসেভায় ৮০ সম্পূর্ণ ও ৩২৯ আংশিক এবং মহেশখালী পৌরসভায় ২০০ সম্পূর্ণ ও ৭০০ বসতি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রশাসনের জরিপে এসেছে।
সূত্র মতে, ৩০ মে (মঙ্গলবার) ভোররাত ৪টা ২০ মিনিট থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর হালকা বাতাস বইতে শুরু করে। এরপর সকাল ৭টা থেকে শুরু হয় ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’র তাণ্ডব। একটানা চার ঘণ্টা চলে এই তাণ্ডব। প্রচণ্ড বেগে ঝড়ো হাওয়ায় কক্সবাজার সদরসহ আশপাশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আঘাত হানতে শুরু করে। চার ঘণ্টার ঝড়ো হাওয়ায় লণ্ডভণ্ড করে ফেলে নান্দনিক সৌন্দর্যের পুরো পর্যটননগরী। কাঁচা, সেমিপাকা ঘর দোকানপাট দুমড়েমুচড়ে ফেলে। টিনের ঘর চেপ্টা, বেড়ার ঘর মাটির সাথে লুটে দিয়েছে ‘মোরা’। শক্তিশালী এই ঘুর্ণিঝড়ের কবল থেকে বাদ যায়নি পর্যটন শহরের তারকা মানের হোটেল মোটেলও। বাতাসের তীব্রতায় প্রায় মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংয়ের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে পড়েছে। কাঁচের সবকিছু মুহূর্তেই উড়িয়ে নিয়েছে ‘মোরা’।
সকাল ১১টার দিকে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়। এরপর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরতে শুরু করে নির্ঘুম রাত কাটানো প্রায় তিন লাখ মানুষ।
কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মোরার আঘাতে প্রায় প্রতিটি সড়কের উপর পড়ে আছে উপড়ানো গাছ আর ডালপালা। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে রাস্তায় পড়ে আছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে গাছ ও ডালপালা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, তীব্রবেগে সকাল সাতটা থেকে শুরু হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতি রেকর্ড করা হয়েছে ঘণ্টায় ১১৫-১২০ কিলোমিটার। পুরো জেলায় আংশিক ও সম্পূর্ণ মিলে ৫২ হাজার ৫৩৯ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। কিন্তু এলাকাবাসী, প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তথ্যানুসারে এর পরিমান আরো বেশি হবে।
সেন্টমার্টিনের ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করলেও তাদের ঘরবাড়ি উপড়ে গেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ শতাংশ ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানিয়েছেন, সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ গ্রামে কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে হতবাক হয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল জানিয়েছেন, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনার ডেইল ও নাজিরারটেক এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির মরিমাণ একটু বেশি হয়েছে।
কক্সবাজার সদরের পোকখালী ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমদ জানান, উপকলূলবর্তী উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব গোমাতলীসহ পুরো ইউনিয়নে বেশ কিছু কাঁচা ঘরবাড়ির চালা উপড়ে গেছে। তবে সেহেরীর পর সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ায় কোন ধরণের দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
তিনি আরো জানান, গোমাতলীতে বেশ কিছু এলাকার বেড়িবাঁধ ভাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে বিগত বছর থেকে। তাই ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালীন সময়ে জলোচ্ছ্বাসের ভয়ে আতংকিত ছিল স্থানীয়রা। কিন্তু দমকা ও ঝড়ো হাওয়া নিয়ে মোরা অতিক্রমকালিন সাগরে ভাটা থাকায় জলোচ্ছ্বাস হয়নি। তাই অনেকে প্রাণে রক্ষা পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মহেশখালীর ধলঘাটা এবং কক্সবাজার পৌরসভার মধ্যে কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘরে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। কুতুবদিয়াতেও কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। চকরিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদরে গাছ পড়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অপর মহিলাটি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় সেটা ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সাথে গণনায় আনা হচ্ছে না। এর বাইরে বড় কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাইনি। জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলা ও পৌরসভার বিস্তীর্ণ এলাকায় ৫২ হাজার ৫৩৯টি কাঁচাঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব এলাকায় গাছপালা উপড়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
এসব ক্ষতির বিপরীতে গত ২৯ মে পাওয়া বরাদ্দসহ পূর্বের মিলিয়ে ২৮৪ দশমিক ৭৭০ মেট্রিকটন ৩০ মে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১১০ মেট্রিক টন জি আর চাল, ৯ লাখ নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও পেকুয়ায় ৭০০ প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী, ৩ হাজার কেজি চিড়া ও ২০০ কেজি গুড় এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ৫ হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী নিয়ে নৌ-বাহিনীর একটি জাহাজ সেন্টমার্টিন পৌঁছেছে। ক্ষতি ও চাহিদার বিপরীতে আরো বরাদ্দ দেওয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।