'রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের একক বৃহত্তম উৎস’
প্রকাশ | ০৬ মে ২০১৭, ১২:২১
সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে তা বাংলাদেশে ‘বায়ু দূষণের একক বৃহত্তম উৎস হয়ে উঠবে বলে দাবি করছে গ্রিনপিস।
আন্তর্জাতিক এ পরিবেশবাদী সংগঠনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকার বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান। সেই দূষণের কারণে ঢাকা ও কলকাতার বৃদ্ধ ও শিশুরাও আক্রান্ত হবে।
গ্রিনপিসের ভাষ্য, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি বছর গড়ে দেড়শ মানুষের অকালমৃত্যু এবং ৬০০ শিশুর কম ওজন নিয়ে জন্মানোর কারণ হবে।
৫ মে (শুক্রবার) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতেএক সংবাদ সম্মেলনে ‘রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র: সম্ভাব্য বায়ু দূষণ ও মানবদেহের উপর প্রভাব’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি, ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। প্রতিবেদনটির প্রণেতা গ্রিনপিসের কয়লা ও বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ লরি মাইলিভিরতা স্কাইপের মাধ্যমে এই সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না বলে সরকার আশ্বস্ত করে আসছে।
কিন্তু সরকার রামপাল নিয়ে ‘অসত্য তথ্য’দিচ্ছে অভিযোগ করে ওই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে ‘সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি’সহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও নাগরিক সংগঠন।
লরি মাইলিভিরতা তার গবেষণা প্রবন্ধে বলেন, “বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদগীরণ সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমসহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের এবং খুলনা, অশোকনগর, কল্যাণগড়, সাতক্ষীরা, বেগমগঞ্জ, বশিরহাট, নরসিংদী, নোয়াখালী, বাসীপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলের বাতাসে বিষাক্ত ধূলিকণার মাত্রা/পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে।”
ঢাকা ও কলকাতার বাসিন্দারা, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বায়ু দূষণের কারণে ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
গ্রিনপিসের এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে যে দূষণ হবে, তাতে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, বয়স্কদের শ্বাসতন্ত্রের রোগের পাশাপাশি শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশের বর্তমান বায়ু দূষণের মাত্রা যদি শূন্য ধরা হয়, ৪০ বছরের মেয়াদকালে এই কেন্দ্রের কারণে ৬ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হবে, ২৪ হাজার শিশুর জন্ম হবে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজন নিয়ে।”
মাইলিভিরতা বলছেন, কেন্দ্রটির কাছাকাছি অঞ্চলের পরিবেষ্টনকারী বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের ২৪ ঘণ্টার গড় মাত্রা নগর অঞ্চলের বর্তমান জাতীয় গড়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে এবং সালফার ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়বে নগর অঞ্চলের গড়ের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ।
তার প্রতিবেদনে বলা হয়, "কেন্দ্রটি থেকে পারদ দূষণের সৃষ্টি হতে পারে, যা শিশুদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করবে। রামপাল কেন্দ্র থেকে যে পারদ ‘অবক্ষেপিত’ হবে, তা চারপাশের প্রায় ৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মাছকে ‘খাওয়ার অযোগ্য করার জন্য যথেষ্ট’। এই কেন্দ্রের আয়ুস্কালে ১০ হাজার কেজি পারদ-কয়লার ছাই এর পুকুরে জমা হবে যা বন্যায় প্লাবিত হয়ে আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই অতিরিক্ত পারদ সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের জলজ খাদ্য চক্রকে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে, লাখ লাখ মানুষের উপর প্রভাব পড়বে।”
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানবিক দিক বিবেচনায় কয়লাভিত্তিক প্রকল্প কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যা আজ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত।”
তিনি বলেন, "বারবার বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দিয়ে এলেও সরকার বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে, বরং ‘অসত্য তথ্য দিয়ে’ সম্ভাব্য এই ক্ষতিকর প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার মুখে বললেও সুন্দরবন বাঁচানোর জন্য কোনো প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা রামপাল প্রকল্পে নেই। এই প্রকল্প নিয়ে সরকারের যে ইআইএ রিপোর্ট, সেটি বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, তার কোনো স্বচ্ছতাও নেই, আর সেটি আমরা আগেই প্রত্যাখ্যান করেছি।”
তিনি বলেন, “আমরা কোনো স্বার্থ বা কারও সাথে আক্রোশ নিয়ে কোনো কথা বলছি না। শুধুমাত্র সুন্দরবন রক্ষা এবং পরিবেশ-মানবিক ও জাতিকে রক্ষার স্বার্থেই রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বলছি এবং সেটা যথেষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য নিয়েই বলছি।”
সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল আবারও জনগণের স্বার্থ ও মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে ‘সুন্দরবনবিনাশী’ রামপাল প্রকল্প বাতিল করার দাবি তুলে ধরেন।
অন্যদের মধ্যে ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার, স্বাস্থ্য গবেষক অধ্যাপক এম আবু সাঈদ, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আব্দুল মতিন এবং সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য শরীফ জামিল অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
মহিদুল হক খান, রুহিন হোসেন প্রিন্স ও মিহির বিশ্বাসসহ বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্য সদস্যরাও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।