চকরিয়াতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০১৬ উপদযাপন

প্রকাশ : ০৭ জুন ২০১৬, ০২:২৩

জাগরণীয়া ডেস্ক

বন সংরক্ষণে জন অংশগ্রহণে বিচ্যুতির কারণে বন্যপ্রাণি ও বনজ সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে বলে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন উপলক্ষে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় বিভিন্ন বক্তারা মত প্রকাশ করেন। চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন, গণসাক্ষরতা অভিযান, আইএসডিই বাংলাদেশ ও চকরিয়াতে কর্মরত বেশ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে বিশ্ব পরিবেশ দ্বিস উদযাপন উপলক্ষে র‌্যালি, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভার আয়োজন করেন।

বন সম্পদ সংরক্ষণে বন বিভাগের অপরাগতা, বন সংরক্ষণে সত্যিকারের জনঅংশগ্রহণে বিচ্যুতি, ব্যাপক হারে বন উজাড় ও প্রাণিহত্যার কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের পরিবেশ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, আর এ কারণে প্রচন্ড গরমে বৈরী প্রাকৃতি আবাহওয়ায় জনজীবন বিপন্ন। বর্ষা কালে বৃষ্টি নাই, শীতকালে শীত নাই, ঘনঘন ঘূর্ণীঝড়, সাইক্লোনসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পুরো দেশ। বন উজাড় হয়ে যাবার কারণে বন্য প্রাণিও তাদের আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে। মনে হয় বন্যপ্রাণি যেভাবে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, একই ভাবে মানুষও বিলুপ্ত হয়ে যাবার উপক্রম বলে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন বক্তারা। 

অন্যদিকে বন সম্পদ সংরক্ষণে সত্যিকারের জন অংশগ্রহণ না থাকায় বন বিভাগের অদক্ষতার কারণে সরকার আর্ন্তজাতিক দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় নানা প্রকল্প গ্রহণ করলেও সেখানে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলি বিবেচনায় না এনে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্প শেষে প্রকল্পের যাবতীয় উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তারা। 

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম খান, সহকারী বন সংরক্ষক মুহাম্মদ ইউসুফ, আইএসডিই বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক এস এম নাজের হোসাইন, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সিপিপির টিম লিডার নুরুল আবচার, দুলহাজারা কলেজের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন চোধুরী, সাহারবিল ইউপি চেয়ারম্যান মহসিন বাবুল, উপজেলা নারী উদ্যোক্তা পরিষদের সভানেত্রী উম্মে কুলসুম মিুন, মেধাকচ্ছপিয়া সিএমসি কমিটির সভাপতি এসএম আবুল হাসেন, এসএআরপিভির সমন্বয়কারী কাজী মাকসুদুল আলম, ক্রেল এর সাইট অফিসার আবদুল কাইয়ুম, সাংবাদিক জাহেদুল আলম প্রমুখ।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেদুল ইসলাম বলেন, “ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে চকরিয়া উপজেলার জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এ বছর ২বার ভয়াবহ ঘুর্নীঝড়ে আক্রান্ত চকরিয়ার মানুষের জীবন জীবিকাও সংকটাপন্ন হয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসের কারণে পরিবেশের এই সংকট। আর এ সংকট মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ও স্থানীয় জনগনের বন ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে একযোগে কাজ করতে হবে। নতুবা পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে পুরো উপকূল হারিয়ে যেতে পারে”। 

তিনি বলেন, “সরকার জলবায়ুর ঝুঁকি কমাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু জনগনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সচেতনতা ছাড়া কোন কার্যক্রমই সফল হবে না। তাই সরকার কোমলমতি শিশুদের মাঝে জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলা, পরিবেশ সংরক্ষণসহ নানা বিষয়ে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে”।

আইএসডিই বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “চকরিয়ার উপকূল তথা কক্সবাজারে জীব বৈচিত্র ও পরিবেশ বর্তমানে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। দেশের অন্যতম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট চকরিয়া সুন্দরবন হারিয়ে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম চকরিয়া সুন্দরবনের কথা বইতে পড়লেও বাস্তবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ সেখানে এখন চিংড়ির ঘের ও খামার”। 

তিনি চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংসের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় দাঁড় করানোর আহবান জানান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বন বিভাগের অক্ষমতার কারণে এবং কিছু প্রভাবশালী মহলের কারণে বন ধ্বংস হয়ে গেছে, অন্যদিকে বনের প্রাণিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। চকরিয়া অঞ্চলে একসময় হাতির বিপুল পরিমান বিচরণ ছিল আজ এটিও ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিচ্ছে। এছাড়াও প্রচুর বন্যপ্রাণি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাণিদের আবাসস্থল হারিয়ে গেলে তারা কিভাবে বেঁচে থাকবে? তাই বন ও বন্যপ্রাণি ধবংসের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র জনমত নয় এর জন্য দায়িদের বিচারের আওতায় আনতে হবে”। 

বক্তারা আরো বলেন, চিংড়ি চাষের নামে সরকার চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংস করেছে আর পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়া বিভিন্ন শিল্প, কলকারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে পুরো উপকূল বিপন্ন হতে পারে। বন্য প্রাণি, মৎস্য সম্পদসহ আমরা এমন অনেক প্রজাতি হারিয়ে ফেলেছি, যেগুলো আর কখনও পরিবেশে ফিরে আসবে না। বনের সম্পদ লুটপাট হচ্ছে, বসতি দিনদিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষিত এলাকাগুলোতেও খাদ্য ও পর্যাপ্ত জায়গার অভাব রয়েছে। খাদ্যের অভাবে হাতি চলে আসছে লোকালয়ে। ফল ও ধানের ক্ষেত আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের অভয়ারণ্য ও আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে। বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বন্যপ্রাণির আবাসস্থল বৃদ্ধি করতে হবে।

বন সংরক্ষণে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় বেশ কিছু প্রকল্প নেয়া হলেও সেখানে বাস্তবায়নকারী সংস্থা নিয়োগ জটিলতায় এমনকিছু সংস্থাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যাদের প্রকল্প শেষ হবার সাথে সাথেই প্রকল্পের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রকল্পের উপকারভোগী নির্বাচনেও রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় সত্যিকারে জনগণ উপকৃত হচ্ছে না।

এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘বন্যপ্রাণি ও পরিবেশ বাঁচায় প্রকৃতি, বাঁচায় দেশ”। সভায় দিবসের মূল প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেন ক্রেল প্রকল্পের চকরিয়া অফিসের আবদুল কাইয়ুম। মুল প্রবন্ধে, ‘বন্যপ্রাণি ও তাদের আবাস্থল এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ এর ‘ক’ অনুচ্ছেদে রয়েছে। মানুষের যেমন বাঁচার অধিকার রয়েছে, তেমনি প্রতিটি প্রাণিরও বাঁচার অধিকার রয়েছে। বন্যপ্রাণিরা বিভিন্নভাবে পরিবেশের উপকার করছে। যেমন পাখি ফসলে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও ইঁদুর, উদ্ভিদের অংকুরোদগম ও বিস্তার, উদ্ভিদের পরাগায়ন, জৈবময়লা আবর্জনা পরিষ্কার, পরিবেশের অবস্থার নির্ণায়ক বা নির্দেশক ইত্যাদি। আবাস্থল ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন ও বন্যপ্রাণির অবৈধ শিকারই বন্যপ্রাণি ধ্বংসের প্রধান কারণ। আফ্রিকাতে প্রায় প্রতি বছর ৩০ হাজার হাতি হত্যা করা হচ্ছে। ভিয়েতনামে বন্যপ্রাণির বিভিন্ন অংশ ও অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রায় ৫-২০ বিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করা হচ্ছে।’ বন উজাড়ের কারণে প্রতিবছর প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

সহকারী বন সংরক্ষক মুহাম্মদ ইউসুফ বলেন, বন ধ্বংস হয়ে জীব বৈচিত্র আজ চরম হুমকির মুখে, ‘পরিবেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। চকরিয়া সুন্দরবন আজ হারিয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদী আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আর মাতামুহুরী বাঁচলে চকরিয়া বাঁচবে।’ ‘বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণি বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হলো, বেআইনি প্রাণিশিকার, বিপণন ও পাচার। এ সকল অবৈধ ও বেআইনি বণ্যপ্রাণি শিকার ও ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। তা নাহলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং পৃথিবীতে মানবজাতির বসবাস হুমকির মুখে পড়বে।’ তিনি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহবান জানান।

এর আগে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১৬ উদযাপন উপলক্ষে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলামের নেতৃত্বে উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে এক বর্ণাঢ্য র‌্যালি আয়োজন করে। র‌্যালিতে বিভিন্ন সরকারি, বেসকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা রালিতে অংশগ্রহণ করেন। এর আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আলোচনা শেষে অতিথিবৃন্দ বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গ্রুপে ১ম হয়েছে নওশিন বিন সাহেদ, চকরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২য় রেকেয়া মাহিন, মধ্য চকরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩য় সামিয়া হক শিরিন, কাহারিয়া ঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক গ্রুপে ১ম তামান্না ইসলাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ২য় মুহাম্মদ ইশান ইমতিয়াজ, চকরিয়া গ্রামার স্কুল, ৩য় তাসফিয়া নুর কাশপিয়া, চকরিয়া গ্রামার স্কুল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত