প্রাণী হত্যা, মানুষ হত্যা এবং কিছু নৃশংস যোগসূত্র
প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০১৬, ০৩:২৫ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৬, ২১:৪১
ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৬ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় ফলাও করে আলোচনায় আসে নির্মম একটি ঘটনা। অনেকে এরই মধ্যে হয়ত সেটি ভুলে গেছে। আমি আবার তা মনে করিয়ে দিতে চাই। আর্জেন্টিনার একটি সৈকতে সেদিন আটকে পড়েছিল এক ডলফিন শাবক। উচ্ছসিত পর্যটকরা ঐ ডলফিনকে পেয়ে মেতে উঠে নির্মম সেলফি উন্মাদনায়। এরপর যা ঘটার তাই ঘটল! হুজুগে ঐসব উন্মাদ পর্যটকদের হাতে খুন হল পৃথিবীর ঐ বিপন্ন ডলফিনটি। খুন? হ্যাঁ খুন; একধরণের সংজ্ঞাহীন খুন। নিরপরাধ প্রাণীর প্রতি মানুষের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ঝড় উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয়। ঝড়তো উঠে থেমে যাওয়ার জন্য। তারপর?
আরেকটি দেশী ঘটনা, মার্চে দেখা। দুজন বালক/কিশোর বয়সি ছেলে খোলা জায়গায় একটি বিস্ফোরণযোগ্য পটকা জ্বালিয়ে ঢেকে দেয়, একি সাথে চলছিল তাদের মোবাইলে ভিডিও ধারণ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি কুকুর ঐ জ্বলন্ত পটকাটির কাছে আসতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়! ভিডিওতে দেখা যায়না ঐ কুকুরটি পরবর্তী অবস্থা, কিন্তু কাজটি যারা করেছিল তারা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা! হাসতে হাসতে ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ‘হাঁসতে হাঁসতে খুন...ফিলিং কুত্তার বিচি কান্দে’ শিরোনামে ভাইরালের মত ছড়িয়ে পড়ে। অবাক করা বিষয় বেশিরভাগ মানুষ সামাজিক মাধ্যমে ভিডিওটি দেখে আনন্দই পেয়েছে, অনেকের আহবান এমন ভিডিও আরো শেয়ার করার জন্য! বিকৃত বিনোদনের এমন মানসিকতা সমাজের জন্য চরম ভীতিকর। কিন্তু একটু নজর দিলে এমন অজস্র ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।
এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে মানুষবাদে অন্য প্রাণীগুলোর সাথে আমাদের আচরণ কত জঘন্য। প্রতিনিয়ত একটি চিত্রতো আমাদের বেশ চেনা; এই যেমন কাঁচাবাজারে কিছু ফ্রিল্যান্সার দেশী হাঁস-মুরগি বিক্রেতাদের দেখা যায়, এলাকার অলিগলিতেও ‘মুরগীই, মুরগীই’ অদ্ভুত চিৎকার করে দ্বারে দ্বারে বিক্রি করে হাঁস-মুরগি। এরা দশ-বিশটা প্রাণীর পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি অথবা একটি ছোট্ট টুঁকড়ি করে গাদাগাদি করে চলে ফিরে। আমি আপনি নাহয় বেঁচে থাকার শরীরী আমিষ মেটাবার জন্য এসব সুস্বাদু প্রাণী খাবো, কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেন এই বিভৎস অত্যাচার? আর পোষ্য প্রাণীদের কথা নাই বললাম!
একটি ঘটনা বলি, আমার বাসায় যে বিড়ালটি আশ্রয়ে বড় হয়েছিল একদিন দেখি ঝলসানো পা নিয়ে বেশ কাতর অবস্থায় সে বাসায় ফিরেছে। বুঝলাম কেউ গরম ভাতের মাড় বা গরম পানি তার গায়ে ছুড়েছিল; নানা চিকিৎসায় কোনো কাজ হলো না। এখন বিড়ালটি পা হীনভাবেই বেঁচে আছে; হয়ত সে নির্মমভাবে খুন হতে পারত। এরকম অজস্র নির্যাতিত প্রাণী আমাদেরই আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, খুন হয়। সমাজের বিবেকহীনদের মাঝে এসব নিয়ে কেউ ভাবে না। না ভাবারই কথা! আরে সমাজে নির্বিচারে মানুষ মরছে, মানুষ মারছে মানুষ। এসব তড়তাজা খবরের কাছে এসব ছাইপাশ খবরতো নস্যি, তাই না! কিন্তু না; মানুষ খুন, ধর্ষণ এসব অপরাধের সাথে প্রাণীর প্রতি সহিংসতা বা নৃশংস আচরণের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। ভেবেছিলাম আমার এই লেখা নিতান্তই একটি মানুষের আচরণের সমালোচনা কোনো কিছু হবে, কিন্তু দিন কয়েক ধরে এসব নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে বেরিয়ে আসলো ভয়াবহ কিছু তথ্য যা আমাকে এই সমস্যা নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে।
সত্তরের দশকের কথা, আচরণগত পর্যবেক্ষণ বা নজরদারি বিজ্ঞানের কাজ শুরু হচ্ছিল এফবিআইতে। ঐকাজটি করতে গিয়ে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে দিকটি উঠে এসেছে তাহল, সিরিয়াল কীলার বা ধর্ষকদের বৈশিষ্টের অন্যতম একটি হচ্ছে শৈশব সময়ে প্রাণীর প্রতি তাদের নৃশংস আচরণ। এফবিআইয়ের সিরিয়াল কীলারদের প্রোফাইল তৈরি করা রবার্ট কে. রেসলার বলেন, ‘খুনীদের শুরুটা হয় প্রাণীকে শিশু ভেবে নিপীড়ন ও হত্যার মধ্য দিয়ে’। মনোবিদ্যা ও অপরাধতত্ত্বের গবেষণায় দেখা যায়, যেসব মানুষ প্রাণীর প্রতি নৃশংস আচরণ করে তাদের অনেকাংশই এ ধরণের আচরণ থেকে সরে না এসে বরং মানুষের প্রতি সহিংস ও নৃশংসতার দিকে ধাবিত হয়।
পঁচিশ বছর ধরে ব্যক্তিত্ব-চরিত্রগত ব্যাঘাত নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি ক্লিনিকাল সাইকোলজি নিয়ে পিএইচডি করেছেন ড. জর্জ সিমোন। তিনি প্রাণীর প্রতি সহিংস আচরণ নিয়ে লিখেছেন, ‘প্রাণীর প্রতি সহিংসতা সংকটজনক এবং ব্যাপক একটি সমস্যা। এটি বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন বয়সের মানুষ এবং ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের মাঝে দেখা যায়। যদি কেউ এমন মানুষ সম্পর্কে জানেন যিনি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাণীর প্রতি সহিংস তবে তার বা তাদের মানসিক সাহায্যের প্রয়োজন’। পাশ্চাত্য এসব পড়াশুনা আমাদের সমাজে একের পর এক ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনার উৎসের প্রতি আমার মনে সন্দেহ তৈরি করেছে।
আরও কিছু ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আমার চিন্তা নিবদ্ধ হয় ষোলশ সালের ইতালীয় চিত্রশিল্পী অ্যনিবেল’র ‘টু চিলড্রেন টিসিং ক্যাট’ শিরোনামের একটি তৈল চিত্রে। হঠাৎ দেখায় ছবিটিকে বেশ সরল মমতাপূর্ণ মনে হয়, কিন্তু যখন ছবিটিকে ভালোভাবে দেখি ছেলে শিশুটি একটি বিছা হাতে ধরে বিড়ালের কানের কাছে নিয়ে এসেছে তারপরেই বোঝা যায় সরল মনের ভয়াবহ দিকটি। আমাদের শিশু মনেও কাজ করে খেলার ছলের এমন নৃশংস আনন্দ। আমার এখনও দুঃখের সাথে মনে পড়ে ছেলেবেলায় ঘাসের জমিনে বসা জীবন্ত ঘাস ফড়িং হত্যার কথা। নিছক খেলার ছলে আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে হত্যা করে আনন্দ পেতাম সেসময়, এখন ভাবতেই কষ্ট হয়! কিন্তু আমরা হয়ত ভাগ্যবান ছিলাম যে পরবর্তীতে আমরা খুনী হয়ে উঠিনি। শিশুদের খেলার ছলে এমন আনন্দ পাওয়ার এমন সহজাত আচরণ প্রায় দেখা যায়। কিছুদিন আগেও দেখেছিলাম একটি আহত কুকুর ছানাকে উত্তক্ত করছে দুটি শিশু। কিন্তু এমন বিকৃত আচরণ নজরদারিতে না পড়লে বা শিশুদের তা থেকে বিরত থাকতে ভালোভাবে না বোঝালে এটি হয়ে উঠতে পারে নিত্য আচরণের অংশ। পাশ্চাত্যের গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রাণীর প্রতি নূন্যতম সহিংসতা যেন উপেক্ষা করা না হয়। এনিয়ে যেন শিশু এবং তার পিতা মাতার সাথে কথা বলা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে কে কাকে বলে এমন সচেতনতা তৈরি করবে?
আমাদের দেশে যারা খাঁচায় পশু পাখি পোষে তা যে অতি অমানবিক বিষয়, এ নিয়ে কেউ কথা বলে না। রাজধানী ঢাকার মত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা প্রাণীদের সমাজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যবসা করে তা নিয়ে কেউ কথা বলে না। রাস্তাঘাটে চলার পথে অযাচিতভাবে প্রাণীদের উত্তক্ত করাকে কেউ অপরাধ ভাবে না। তাহলে আমাদের আমাদের সচেতন হতে সামাজিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন। প্রাণীর প্রতি সদাচরণ পাঠ্য বইয়ের বিষয়ে অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োজন এসব নিয়ে নজরদারির। প্রাণীর প্রতি দু একটি বিচ্ছিন্ন ভাল ঘটনা সামগ্রিকভাবে প্রাণীর প্রতি নৃশংস আচরণ কমানোর অন্তরায়। ফান্ডের অপেক্ষা না করে, ক্ষুদ্র সামাজিক সচেতনতা হিসেবে উপেক্ষা না করে নিজ গৃহেই নিতান্ত সদিচ্ছাই তৈরি করা যায় এমন সচেতনতা।
‘যদি কসাইখানাগুলোই আয়নার তৈরি দেয়াল হতো, তবে বোধহয় আমরা সকলে নিরামিষভোজীই হতাম’ এমন অন্তর্ভেদী কথা বলেছিলেন দুনিয়া কাঁপানো বিখ্যাত বিটলস শিল্পী পল ম্যাকার্টনি। তাই বলে সকলকে নিরামিষভোজি হওয়ার আহবান জানাচ্ছি না। প্রাণীর প্রতি নৃশংস আচরণের বিরূদ্ধে বোধ জাগ্রত হলেই হবে। এই লেখাটি আরও বিশদে বিস্তৃত করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মানুষকে নিজের অবস্থানটি ধরিয়ে দিতে এটুকুই বোধকরি যথেষ্ট।
লেখক: ভিজ্যুয়াল জার্নালিস্ট, বিবিসি এমএ।