বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা

প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০১৮, ২১:৩৫

ছোট্ট একটা মিষ্টি নীলচে রঙয়ের একটা খুবই দুষ্ট আর চঞ্চল পাখি যাকে দেখলেই মনের অজান্তেই গুনগুন করতে থাকি, ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা’। পাখিটির নাম- 'কালাকপাল বনমালী' যার ইংরেজি নাম 'Velvet-fronted Nuthatch'। পাখিটির সাথে প্রথম দেখা ২০১২ সালে সিলেটের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে হলেও এরপর সুন্দরবনে বহুবার তার সখ্যতা পেয়েছি। সবুজ অরণ্যের মাঝে নীল আর লালের সেই চমৎকার কারুকার্য দেখার সাথে সাথে যে কেউ তার প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য। পাখিটি মূলত বাংলাদেশ, ভারতদক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। 

কালাকপাল বনমালী লাল ঠোঁটের ছোট নীলচে পাখি। পাখির দৈর্ঘ্য মাত্র ১০ সেন্টিমিটার, ডানা ৮ সেমি, ঠোঁট ২.২ সেমি, পা ২ সেমি, লেজ ৪.৩ সেমি এবং ওজন ২৪ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ বেগুনি-নীল; ওড়ার পালক কালচে, আগাসমেত কালচে নীল। থুতনি ও গলার মাঝখানটা সাদা। দেহতলের অবশেষ হালকা, কিছুটা পীত বাদামি। কপাল মখমল কালো, যার সঙ্গে চোখের সামনে-পেছনের কালো মোটা দাগ মিলেছে। স্ত্রীপাখির এ কালো দাগ নেই। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির উভয়ের চোখ ও চোখের বলয় হলুদ। বলিষ্ঠ লালচে ঠোঁটের ওপরের অংশের প্রান্তদেশ বাদামি, পা ও পায়ের পাতা পাটকিলে বাদামি। পায়ের তল কমলা-হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির ঠোঁট কালচে ও অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল ধূসর দেহতলে কমলা পীতাভের আভা থাকে। 

কালাকপাল বনমালী প্রধানত প্যারাবনে বিচরণ করে। পাতাঝরা ও চিরসবুজ বনেও দেখা যায়। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট পারিবারিক দলে বিচরণ করে। সাধারণত উড়ে এসে বসে গাছের প্রধান কাণ্ডে। বনের ভেতর থেকে উড়ে এসে কাণ্ডের বাকল ও গাছের পুরোনো বড়, শেওলাঢাকা ডালের বুকে হেঁটে এরা ঠুকরে খাবার খায়। খুব দ্রুত সময়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গাছের কাণ্ডের পোকা খেয়ে উড়ে গিয়ে বসে অন্য এক গাছের কাণ্ডে। খাদ্যতালিকায় আছে পোকা ও লার্ভা। গাছের গা আঁকড়ে থাকতে ও ওপরে-নিচে চলাচলে এরা অত্যন্ত পটু। সাধারণত খাবারের সময় চিট চিট বা সিট সিট শব্দ করে ডেকে বেড়ায়।

এরা গ্রীষ্মকালে (জানুয়ারি-মে মাসে) গাছের ফোকরে শ্যাওলা, পশম ও পালক বিছিয়ে ছোট বাসা বানায়। দুই থেকে ছয়টি লালচে ছোপযুক্ত সাদা ডিম পাড়ে। ডিমের মাপ ১.৭×১.৩ সেমি। পুরুষ ও স্ত্রীপাখি মিলে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৪-১৬ দিনে। ১৫ দিনের দিন ছানারা বাসা ছাড়ে। 

কিন্তু হতাশার কথা হলো বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, তবে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যদি এদের আবাসস্থল সংরক্ষণ করা না যায় তাহলে যেকোন সময় এদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই এদের আবাসস্থল বনভূমি বাঁচানো একান্ত জরুরী। 

লেখক: জীববিজ্ঞানী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত