ঐতিহ্যকে সাথে নিয়েই দেশটা উন্নত হোক
প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:০৯
আমার মাস্টার্স কোর্সের ডেসার্টেশান করার সময় মূল বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে, অল্প পরিমানে হলেও আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাকে একটু জানতে হয়েছিল।
বিষয়টি ছিল - "Corporate Responsibilities on society and Nature".
আগেই বলেছি, এই বিষয়টা নিয়ে খুব বেশী নাড়াচাড়ার সুযোগ ছিল না - তাই আসলে জানার সুযোগও খুব বেশি ছিল না। যতটুকু জেনেছি, বেশিরভাগই ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে।
তখন জেনেছি, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সরকারের পাশাপাশি কিভাবে বড় বড় কোম্পানিগুলো নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে দেশের তথা বিশ্বের পরিবেশ রক্ষায়, কিভাবে বছর বছর বিশাল পরিমান অর্থ-জনবল ব্যয় করছে।
ইউরোপের অন্যান্য শহর অথবা আমেরিকা কানাডার তুলনায় লন্ডন অতি পুরানো একটি শহর। এই শহরের অলিগলিতে এত এত পুরানো ঐতিহ্যবাহী, বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি বিজড়িত জায়গা রয়েছে যে, সেগুলো দেখতে দেখতে পা আর চোখ ব্যথা হয়ে যাবে কিন্তু সেই সব জায়গা শেষ হবে না! সেগুলো দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমের ঘোরে প্রাচীন কালের রাজদরবার থেকে শুরু করে ডাইনী-ড্রাকুলার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না!
কিন্তু এই শহর পুরনো হলেও, আধুনিকায়ন-উৎকর্ষতা, নতুন নতুন মানুষদের জন্য স্থান সংকুলান কোন কিছুই তো আর থামিয়ে রাখা যায় না, তাই এই প্রাচীন শহরেও বিশ্বের তাবৎ আধুনিক শহরগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নয়ন হয়। তাই বলে সেই ঐতিহ্যময়, ঐতিহাসিক স্থানগুলো তো অবশ্যই, এমনকি সাধারণ পুরনো বিল্ডিং, দর্শনীয় স্থানগুলোও গুড়িয়ে নয় বরং অতি যত্নে, মমতায় সেগুলো সংরক্ষণ করে, সংস্কার করে!
একসময় সারা পৃথিবী জুড়ে শাসন-শোষণ করেছে বলে নিজেদের কুকীর্তির সাক্ষ্যও কম নেই এমনতর স্থানগুলোতে! কিন্তু তারপরও এরা পারতপক্ষে সেইসব ঐতিহাসিক জায়গাগুলো নষ্ট করতে নারাজ। নিজেদের অতীতকে এরা মুছে ফেলতে চায় না, আর এভাবেই এরা, এদের মানুষগুলো পেয়েছে 'সভ্য' মানুষের তকমা।
নিজেদের অতীতের স্মৃতি চিহ্নগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এরা তুলে দিতে চায় পরম মমতায়, অক্ষত অবস্থায়।
শুধু ইংল্যান্ড না, ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-জাপান মূলত পৃথিবীর বুকে সভ্য দেশ বলে যারা পরিচিত, তারা সবাই এই একই কাজ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যারিসবাসী তাদের বাড়িগুলোর মতো, বিখ্যাত লুভ্যুর জাদুঘরও একই রঙ এ রাঙিয়ে রাখতো- যাতে জার্মান বিমান বাহিনী সেই জাদুঘরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে বোমা বর্ষণ করতে না পারে! এতটাই মায়া ছিল তাদের সেই জাদুঘরটির জন্য!
এবার ফিরি আমাদের দেশে-
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ ছাড়ার কষ্টের আবার একই সাথে স্বাধীন দেশে ফেরার আনন্দময় কোটি মানুষের মুখের প্রতিচ্ছবি- সাক্ষী হয়ে আছে বিখ্যাত 'যশোর রোড'।
আমাদের এই মাত্র প্রায় অর্ধশত বছরের রাষ্ট্রে, যশোর রোডের শতবর্ষের গাছগুলো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের সব স্মৃতি নিয়ে- বলা চলে এরা মিশে আছে আমাদের পুরো জাতি সত্ত্বায়!
এই গাছগুলো মিশে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করা মানুষগুলোর স্মৃতিতে, এরা মিশে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখা- শোনা মানুষগুলোর স্মৃতিতে, এমনকি এরা মিশে আছে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য প্রার্থনায় বিদেশীদের তৈরী করা গানের কথাতেও!
এসব ঐতিহ্য- ঐতিহাসিক হিসাব- মনের 'সস্তা আবেগ'টুকু বাদ দিলেও আমাদের মতো একটা দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়- এই শত বছরের পুরানো, বিশাল বিশাল শতবর্ষী গাছের গুরুত্ব যদি কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয়, তাকে অন্তত শিক্ষিত বা সভ্য মানুষ বলা যায় না!
অথচ চার লেনের মহাসড়ক তৈরীর জন্য, যশোর রোডের সেই গাছগুলো কাটার আদেশ নাকি ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে!
ভাবতেই, অবাক লাগে এই দেশে এমন গণ্ডমূর্খ-অসভ্য মানুষরা এখন এমন সব জায়গায় পৌছে গিয়েছে, যেখান থেকে কলমের খোঁচায় মূহুর্তের মধ্যে নিজেদের গৌরবময় ইতিহাসের অংশকে মুছে ফেলা যায়, দেশের ভবিষ্যৎ পরিবেশকে ফেলা যায় মারাত্মক ঝুঁকির মুখে!
একটু সময় নিয়ে দেখলে, আমাদের রোড এন্ড হাইওয়েজের ডিজাইনাররা সেই গাছগুলো রেখেই চারলেনের মহাসড়ক তৈরীর একটা নকশা নিশ্চয়ই করতে পারবেন।
আমাদের মনে রাখা দরকার, টাকা হলেই চার লেন না এরচেয়ে বেশী লেনের মহাসড়ক-ফ্লাইওভার-সেতু সবই করা সম্ভব, এই রকম অসভ্য-অশিক্ষিত সরকারী তোষামোদি চামচা ভুড়িভুড়ি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এমন স্মৃতি বিজড়িত শতবর্ষী একটা গাছ ফিরে পাওয়া সম্ভব না, আর আমরা সেখানে বলছি হাজার হাজার গাছ নিধনের কথা!
আমরা বিদেশে বসেও এই খবর পেয়ে গিয়েছি, সেক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত এই সরকারের অতি উচ্চ পর্যায়ের লোকজনও এই খবরটা জানেন।
আশা করি, তারা ব্যাপারটা বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সুন্দর সমাধান করবেন।
এই জাতির সীমাহীন কষ্টের দিনেও শীতল ছায়া আর মায়ায় আমাদের জড়িয়ে আগলে রাখা এত সুন্দর সুবিশাল গাছগুলোকে এভাবে না কেটেও দেশের উন্নয়ন করা খুব ভালোভাবেই সম্ভব।
তবে হোক না দেশটা উন্নত, অতীতের সব ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে পাশে রেখেই। যাতে একদিন আমরাও প্রজন্মান্তরের কাউকে বলতে পারি- এই যশোর রোড আর সেই সুবিশাল গাছগুলোর সাথে মিশে থাকা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের কথা।
আর কে-ই বা না জানে যে, গাছ বাচলেই জীবন বাঁচে। কি হবে সেই উন্নয়ন দিয়ে, যদি সেই উন্নয়ন দেখার জন্য, উপভোগ করার জন্য কেউ বেঁচেই না থাকে!
আর কোন কারনে না হোক, অন্তত আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আরেকটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই না হয় যশোর রোডের গাছগুলো বেঁচে থাকুক!
আর এই দাবী হোক প্রতিটি সুস্থ-সভ্য বাংলাদেশীর।
লেখক: চাকুরীজীবী