‘আমাদের ভাষা এক, ভালোবাসা এক’
প্রকাশ | ২০ জুন ২০১৬, ০২:১৯
এপার কিংবা ওপার বাংলা যেখানেই বলি, বাংলা কবিতা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে আবৃত্তি শিল্পীদের অসামান্য অবদানকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কলকাতায় বাচিকশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন কাজী সব্যসাচী, প্রদীপ ঘোষ, নীলাদ্রি শেখর বাসুর মতো অনেকেই আর সেই পথেই আবৃত্তিশিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন অনেকে। তাদের মধ্যে কারো কারো কণ্ঠের যাদু ডিঙিয়ে গেছে সীমান্তের কাঁটাতার। মুনমুন মুখার্জি কলকাতার তেমনই একজন জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী, যার আবৃত্তির যাদুতে মুগ্ধ আমাদের দেশের অনেক শ্রোতা। আবৃত্তির ভেতর বাহির নিয়ে জাগরণীয়ার পক্ষে মুনমুন মুখার্জির সাথে কথা বলেছেন শাহাদাত রাসএল।
শাহাদাত রাসএল: আবৃত্তির প্রতি ভালোলাগার শুরুটা কীভাবে?
মুনমুন মুখার্জি: ছোটবেলায় যা ছড়া পড়তাম সেগুলোই বারবার বলতাম। ভাল লাগতো সবার। সেই শুনে মা একদিন ৫ বছর বয়সে আবৃত্তি স্কুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলো। আরো অনেক কিছুতেই ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু টান ছিলো আবৃত্তির প্রতিই।
শাহাদাত রাসএল: আবৃত্তি মাধ্যমটাকে শিল্প বলা হয় কেন?
মুনমুন মুখার্জি: আবৃত্তি অবশ্যই শিল্প কারন আবৃত্তির অর্থ হচ্ছে শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা, শ্রোতার মনে শব্দ দ্বারা একটি দৃশ্য চিত্রায়িত করা।
শাহাদাত রাসএল: কবিতা পড়া আর আবৃত্তি কোনটা বেশি আনন্দদায়ক আপনার কাছে?
মুনমুন মুখার্জি: কবিতা পড়ার পর সেটা আবৃত্তির ইচ্ছে জাগে। কবিতার অক্ষরগুলোকে নিজের বোধ দিয়ে পৌঁছে দিতে ইচ্ছা হয় শ্রোতার কাছে, অথবা শুধুই কখনো নিজের কানে। তাই এই দুটোই একে অপরের সাথে জুড়ে আছে।
শাহাদাত রাসএল: এমন কোন কবিতা আছে যেটা নীরবে পড়তেই বেশি ভালোবাসেন?
মুনমুন মুখার্জি: এমন অসংখ্য কবিতা আছে যেগুলো শুধু একান্তেই পড়তে ইচ্ছা করে ঠিক যেমন গল্প পড়তে ইচ্ছে করে। কিছু কবিতা থাকে শুধু পড়ার জন্যই, নিজস্ব, শুধু নিজে অনুভব করার জন্য।
শাহাদাত রাসএল: এ পর্যন্ত কার কবিতা সবচেয়ে বেশি আবৃত্তির জন্য বেছে নিয়েছেন?
মুনমুন মুখার্জি: ছোটবেলায় প্রথম সেই পাঠ্যবইতে রবিঠাকুর এর ছড়া, কবিতার সাথে পরিচয়, তারপর যতবার যাই বলি সবচেয়ে বেশি তিনিই এসেছেন, আজও আছেন। তাই বিভিন্ন কবির কবিতা আবৃত্তি করলেও সবচেয়ে বেশি হয়তো বিশ্বকবিই এসেছেন আবৃত্তিতে।
শাহাদাত রাসএল: একালের কবিদের মধ্যে আবৃত্তিযোগ্য কবিতার ক্ষেত্রে কাদের কবিতাকে প্রাধান্য দেবেন?
মুনমুন মুখার্জি: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একটু কঠিন। কারণ একজন কবি লিখে যান তার সৃষ্টির নেশায়। সেটা আবৃত্তিযোগ্য হবে কি হবে না সেটা ভেবে সম্ভবত লেখেন না। তাই কারোই সব কবিতা আবৃত্তিযোগ্য হয় না।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি বলতে পারি আবৃত্তির জন্য কবিতা নির্বাচনের সময় আমি প্রথমেই কবিতাটা দেখি, তা যার লেখাই হোক। হয়তো প্রথমবার তার লেখা পড়ছি তাতেও যদি মনে হয় সেই কবিতাটা আমি সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারবো, বলি সেটা। তাই ওভাবে নির্দিষ্ট কারোর লেখায় প্রাধান্য দেবার কথা ভাবিনি কখনো।
শাহাদাত রাসএল: শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম নয়, আবৃত্তিটাকেই বেছে নিলেন কেন?
মুনমুন মুখার্জি: ঠিক বেছে নিয়েছি এমন নয়, ছোট থেকে আমরা নাচ গান আঁকা সবই করেছি, কিন্তু আবৃত্তিটা যেন কখন প্রাণের সাথে জুড়ে গেছে! ওটা ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। জীবনের অপরিহার্য একটা অংশ কোথাও যেন আবৃত্তি। তাই ওটা ছেড়ে থাকা যায় না বা থাকতে পারি না।
শাহাদাত রাসএল: শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে কম বেশি আর্থিক নিশ্চয়তা আছে, জীবনের জন্য অর্থটা নিশ্চয়ই জরুরি। আবৃত্তিতে তা একেবারেই নেই বললেই চলে। তাহলে কি একথা বলা যায়, 'শিল্পের জন্য শিল্প' বলে যে ব্যাপারটা তা আবৃত্তিতেই অধিকাংশে বিদ্যমান?
মুনমুন মুখার্জি: আবৃত্তিকে যারা সারাজীবন আঁকড়ে রাখেন তাদের সেই আঁকড়ে রাখাটা অসম্ভব ভালোবাসার জায়গা থেকে। কারন কয়েকজন বাদ দিলে আবৃত্তির অনুষ্ঠান করে অর্থ উপার্জন করা খুব বেশি শিল্পীর ক্ষেত্রে হয় না। এক্ষেত্রে কয়েকটা কথা বলার আছে আমার, আবৃত্তি করে উপার্জনের কথা বাদ দিলাম কিন্তু আবৃত্তি শিল্পকে নাচ গান বা অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি একই মঞ্চে উপস্থাপন করতে গেলেও আজ অর্থের প্রয়োজন আছে। এটা শ্রোতা বা আয়োজকদের মাথায় রাখা উচিত। কিছু ঘরোয়া অনুষ্ঠান বা নিজে যখন একটা আবৃত্তি করছি সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের পাশে যখন একজন আবৃত্তিশিল্পী আবৃত্তি পরিবেশন করেন তখন কেবল তার কণ্ঠ ছাড়াও আজ আরও কিছু অনুষঙ্গের প্রয়োজন হয় যা ব্যয়সাপেক্ষ। তাই আবৃত্তি শিল্পের বিস্তারে এই ক্ষেত্রে স্পন্সর ভীষণ জরুরী।
শাহাদাত রাসএল: আপনার প্রিয় আবৃত্তিশিল্পী কে? তার কোন দিকটি ভালো লাগে?
মুনমুন মুখার্জি: কোন একজনের নাম বলা সম্ভব নয় এক্ষেত্রে। যাদের কবিতা শুনে বড় হয়েছি অনুপ্রাণিত হয়েছি তেমন অনেকেই খুব প্রিয় শিল্পী। যেমন কাজী সব্যসাচী, প্রদীপ ঘোষ, নীলাদ্রি শেখর বাসু, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, বিজয়লক্ষ্মী বর্মন, এবং অবশ্যই ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। এদের প্রত্যেকের বাচন শৈলীতে নিজস্বতা আছে, যা আমাদের মন কেড়েছে বারবার। এদের বাহিরেও অনেকেই আছেন যাদের নাম বলা হয়নি।
শাহাদাত রাসএল: বাংলা কবিতা আবৃত্তির বর্তমান চালচিত্র এবং সম্ভাবনার কথা বলুন।
মুনমুন মুখার্জি: বাংলা কবিতার সম্ভাবনা বা চালচিত্র নিয়ে ওপার বাংলা মানে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, তারা কেবল বাংলা কবিতা নয় বাংলা সাহিত্যকেই পরম যত্নে লালন করেছেন এবং করছেন। আর এপার বাংলা মানে আমাদের পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে একটা মিশ্র সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কথাটা হয়তো কিছুটা সত্যি, কিন্তু বাংলা কবিতা পড়েন না বা বাংলা কবিতা আবৃত্তি শোনেন না এপার বাংলার মানুষ এমনটা যারা মনে করেন আমি তাদের সাথে একমত নই। কারণ আমার নিজের আবৃত্তি আমি দেখেছি হাজার হাজার শেয়ার হচ্ছে এই বাংলার সোশ্যাল মিডিয়ায়। সুতরাং সিরিয়াসলি নিজের অনুভূতি দিয়ে কবিতাকে উপস্থাপন করতে পারলে কবিতা দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় আজও। এটা আমি বিশ্বাস করি। আর বহু প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় আবৃত্তিশিল্পী কাজ করে যাচ্ছেন এই বাংলাতেও অক্লান্ত ভাবে।
শাহাদাত রাসএল: কবি ও আবৃত্তিশিল্পীর মধ্যে সম্পর্কটাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
মুনমুন মুখার্জি: কবির ভাবনার অক্ষরগুলো যখন শব্দ দিয়ে কণ্ঠে প্রতিফলিত হয় তখনি সেটা আবৃত্তি। তাই কবির ভাবনা ও অক্ষরগুলোকে যথার্থভাবে অনুভব এবং অনুধাবন করাটাই একজন আবৃত্তিশিল্পীর প্রথম কাজ। প্রয়োজনে কবির সাথে আলোচনা করে তার ভাবনাটা বুঝে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু কবির ভাবনাকে অনুধাবন করতে না পারলে তা সার্থকতা পায় না আবৃত্তি রূপে।
শাহাদাত রাসএল: বাংলাদেশের কোন কোন কবির কবিতা আপনাকে মুগ্ধ করে? কেন করে?
মুনমুন মুখার্জি: অনেক নাম আছে। কয়েকজনের নাম বলছি তার মধ্যে, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, হেলাল হাফিজ, নির্মুলেন্দু গুণ এমন অনেকের কবিতাই আমাকে মুগ্ধ করে। এখন নতুন যারা লেখেন তাদের অনেকের লেখাও বেশ লাগে। সৌমেন, অনন্তদের কবিতাও আবৃত্তি করেছি। ভালো লাগে সে কবিতা যে কবিতা ‘মরমে পশিয়া যায়’।
শাহাদাত রাসএল: বাংলাদেশের আবৃত্তিশিল্পীদের আবৃত্তি শোনা হয়?
মুনমুন মুখার্জি: অবশ্যই। শিমুল মুস্তফার আবৃত্তি ভালো লাগে। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মরহুম গোলাম মোস্তফা এমন বেশ কিছু নাম আছে।
শাহাদাত রাসএল: নবীন বাংলা কবিদের কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
মুনমুন মুখার্জি: অনেকেই প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন। অনেকেই বেশ ভালো লিখছেন। আর আজ একটা সুবিধা আছে। আগেও বহু কবি ভালো লিখেও হয়তো হারিয়ে গেছেন। তাদেরকে আমরা চেনার বা জানার সুযোগ পাইনি। আজ ইন্টারনেটের সুবাদে অনেকের কাছে পৌঁছে যাওয়াটা সুবিধাজনক অনেকটাই। আজ আর কাঁটাতার, দেশ, সীমান্ত কিছুই আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না একে অন্যের সাথে সৃষ্টি বিনিময়ের ক্ষেত্রে।
শাহাদাত রাসএল: আবৃত্তিশিল্পী মুনমুনের বাইরে ব্যক্তি মুনমুনের পেশা ও পরিবারের বিষয়ে জানতে চাই
মুনমুন মুখার্জি: আমি প্রায় ৮ বছর পেশাগতভাবে বাংলা দূরদর্শণের বিভিন্ন চ্যানেলে সঞ্চালিকা হিসেবে কাজ করেছি। শেষ তিন বছর কাজ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে প্রবাসে ছিলাম। আবার পুরোপুরি নিজের দেশে নিজের কাজে ফিরেছি কয়েক মাস হলো। ছোটবেলা থেকে মা খুব ইন্সপায়ার করেছেন আমার সব কাজে। এখন সেই উৎসাহটা পাই মা, স্বামী এবং যারা নিকট বন্ধু তাদের কাছ থেকে। তিন বছরের এক কন্যা আছে আমার।
শাহাদাত রাসএল: আবৃত্তির বাইরে যদি আপনাকে সাহিত্যের অন্য একটি শাখা বেছে নিতে বলা হয় তবে কোন শাখাটা বেছে নেবেন?
মুনমুন মুখার্জি: আবৃত্তির বাইরে শিল্পের আরেকটি শাখায় আমি কাজ করছি পেশাগতভাবে উপস্থাপিকা হিসেবে টেলিভিশনে। তবে খুব সচেতনভাবেই আমি পর্দার বাইরে মঞ্চে উপস্থাপিকা হিসেবে কাজ করি না। মঞ্চে আমি শুধু আবৃত্তি করি আর ভবিষ্যতে এটাই করবো।
শাহাদাত রাসএল: বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা কবিতায় কিছু মৌলিক পার্থক্য খুঁজে পান?
মুনমুন মুখার্জি: আমাদের ভাষা এক, ভালোবাসা এক, এতো বড় মিল যেখানে সেখানে আর বাংলা কবিতায় পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করিনি কখনো।
শাহাদাত রাসএল: বাংলাদেশে আপনার আবৃত্তির অনেক মুগ্ধ শ্রোতা রয়েছে। তাদের জন্য কিছু বলবেন?
মুনমুন মুখার্জি: আমি আপ্লুত যে আমার আবৃত্তি তারা গ্রহণ করেছেন। এভাবেই আগামী দিনে তাদেরকে পাশে পেতে চাই। আর ভবিষ্যতে সামনে থেকে তাদেরকে আবৃত্তি শোনাতে চাই। আশা করি সে সুযোগ কখনো আসবে।
শাহাদাত রাসএল: আমাদের পত্রিকা ও বাংলাদেশের কবিতাপ্রেমী পাঠক শ্রোতাদের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
মুনমুন মুখার্জি: ধন্যবাদ। আমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বন্ধুদের জন্য পবিত্র ঈদ আর রথ যাত্রার আগাম শুভেচ্ছা রইলো।