‘প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে’
প্রকাশ | ৩১ মে ২০১৬, ১৬:২০ | আপডেট: ৩১ মে ২০১৬, ১৬:৩৪
অনেকেই বলে থাকেন যে যারা র্যাম্প থেকে আসে তারা অভিনয় জানেন না। সেইসব সমালোচকদের মুখ কিছুটা হলেও বন্ধ করে দিয়েছেন মডেল ও অভিনেত্রী নুসরাত জাহান খান নিপা। যদিও নিপা এখনো নিজেকে অভিনয়ের একজন নাদান বাচ্চা বলেই মনে করেন। সামনে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পরিণত হতে চান শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রি হিসেবে। কিন্তু এখনই তিনি একই সাথে র্যাম্প ফ্যাশন আর টেলিভিশন নাটকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সম্প্রতি অপরাজিতা ধারাবাহিকে তার সাবলিল অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শককে। আজকে জাগরণীয়া’র মুখোমুখি নিপা।
জাগরণীয়া: কেমন আছেন?
নিপা: আলহামদুলিল্লাহ খুবই ভালো আছি।
জাগরণীয়া: বর্তমান ব্যস্ততা কি নিয়ে?
নিপা: এই মুহুর্তে দীপ্ত টিভির প্রতিদিনের ধারাবাহিক ‘অপরাজিতা’ আর ঈদ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন হাউজের ফটোশুট নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছি।
জাগরণীয়া: দীপ্ত টেলিভিশন এর বাহিরে কি কোন কাজ করছেন না?
নিপা: হ্যা। করছি তো। এই মুহুর্তে বাইরে বেশ কিছু হাউজের ফটোশুট ও র্যা ম্প শো করছি তবে নাটকের কাজ করছি না। কিছু নাটকে কাজের কথাবার্তা চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক মিলে গেলেই কাজ করবো।
জাগরণীয়া: অভিনয়শিল্পী যদি নির্দিষ্ট কোন চ্যানেলের জন্যই শুধু কাজ করে বা বেতনভুক্ত চাকুরী করে তবে কি তার শিল্পীসত্বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়না?
নিপা: নির্দিষ্ট চ্যানেলের জন্যও যদি শুধু কাজ করে সেখানেও সে অভিনয়ের কাজটাই করবে। তবে হ্যাঁ শিল্পী মানেই ভিন্নরুপে কাজ করা। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তোলা। শিল্পী তার কাজটা করে যায়। সেটা যদি বেতনভুক্ত হয়েও করা যায় ক্ষতি কি? মোটকথা শিল্পের মাঝে থাকা। আর যতদুর জানি কোন চ্যানেল এমন কোন বিধিনিষেধ আরোপও করেনি যে শুধু ওই চ্যানেলেই কাজ করতে পারবে বাইরে পারবে না।
জাগরণীয়া: সাম্প্রতিকতম সময়ে সাবিরা নামের একজন মডেল আত্মহত্যা করেছে যা আলোচিত হয়েছে। এমন অনেক ঘটনা আগেও ঘটেছে মিডিয়াপাড়ায়। মিডিয়ার নারীদের ভেতর এই আত্মহত্যা প্রবনতা নিয়ে আপনার বক্তব্য কি?
নিপা: প্রথম কথা হলো আত্মহত্যা প্রবনতা টা শুধু মিডিয়াতেই বিদ্যমান তা না। এটা সমাজের সব সেক্টরেই আছে। মিডিয়ার প্রতিটি ব্যক্তিত্ব আদতে সাধারণ মানুষ। তারাও অন্য সবার মত কষ্ট পায়, দুঃখ পায়। মিডিয়ার ব্যাপারটা প্রকাশ্যে আসে বেশি তাই এটা নিয়ে তোলপাড় হয়। এটা পুরোটাই মানসিক ধারণ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। ব্যক্তিগত জীবন কার না আছে? প্রত্যেকের জীবনেই কম বেশি দুঃখ কষ্ট থাকে। সেটা মেনে সামলে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। ছোট বড় যে কারনেই হোক আত্মহত্যা কখনোই কোন সমস্যার সমাধান হতে পারেনা। এটা কাপুরুষতার অপর নাম। জীবনের সব পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে মানুষ হবো কিভাবে আমরা?
জাগরণীয়া: নবীন একজন নারী অভিনয় শিল্পীর জন্য কাজের ক্ষেত্রে কোন কোন প্রতিবন্ধকতাগুলো থাকে?
নিপা: নবীন একজন নারী অভিনয়শিল্পীর কাজ করতে আসার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার থেকেই প্রথম বাধাটা আসে কারন সামাজিক ভাবে ‘অভিনয়’ কে স্বাভাবিক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মানসিকতা সমাজে নেই বললেই চলে। ঘরের বাধাটা ম্যানেজ করে যদিওবা বাইরে কাজ করতে আসা যায় এরপর সামনে আসে ভিন্ন চেহারা। নারীর শরীর এখানে সবচেয়ে বড় বাধা। কাজ দেয়ার আগে প্রত্যেকেই তাদের বিনিময় চায়। এবং কাজের বিনিময়ে একমাত্র চাহিদা নারীর শরীর। ব্যাপারটা মিডিয়াতে না শুধু কর্পোরেট সেক্টরেও একই চেহারা। বসের সাথে তথাকথিত সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে নাহলে আপনার জায়গায় অন্য কেউ চলে আসবে।
জাগরণীয়া: নারীবান্ধব শিল্প মাধ্যম তৈরিতে কোন কোন বিষয়ে পরিবর্তন আনা জরুরী বলে মনে করেন
নিপা: প্রথমেই দরকার মানসিকতা। নারীদের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা। শুধু এই একটা মানসিকতা সবার ভেতর থাকলে আজকের সাক্ষাতকারের মত কথা খরচ করার কোন প্রয়োজনই কোনোদিন পড়বে না। আপনারও এমন প্রশ্ন করার দরকার হবেনা। পরিচালক হিসেবে আরো নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। তারচেয়ে বেশি আসতে হবে প্রযোজক হিসেবে। প্রতিটা সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়াতে হবে। মেধাসম্বলিত এবং যোগ্যতা সম্পন্নদের এই পেশায় আসতে হবে।
জাগরণীয়া: আমাদের দেশের দর্শকরা আমাদের নাটক দেখার চেয়ে ভারতীয় নাটকের প্রতি বেশি আগ্রহী কেনো? এর জন্য কোন বিষয়গুলোকে দায়ী মনে করেন?
নিপা: এটার কারণ নির্মাণ শৈলী এবং তাদের কাহিনী বলার ধরণ। বারবার দেখা একই কাহিনী বা কাছাকাছি ধরণের ঘটনা শুধুমাত্র গল্প বলার ধরণে নতুনত্ব আনার মাধ্যমে দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখা সহজ ব্যাপার না। তারপর আসে অভিনয়ের ব্যাপার। ছোটবড় প্রতিটি চরিত্রের প্রত্যেকের অসাধারণ সাবলীল অভিনয়ক্ষমতা, দৃশ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী সঙ্গীতের ব্যবহার, এডিটিং এর নৈপুন্য, দৃষ্টিনন্দন সেট, পরিমিত বিজ্ঞাপন সবকিছু মিলিয়েই দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখে তারা। দিনভর পরিশ্রম করে দিনশেষে সাধারণ মানুষ বিনোদন চায়, পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটু আনন্দে সময় কাটাতে চায়। স্বাভাবিকভাবেই তারা যেখানে বিনোদন পাবে সেখানেই ঝুকবে। যতদিন আমরা দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী তাদের বিনোদন দিতে না পারবো ততদিন বাংলাদেশী চ্যানেলে তাদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।
জাগরণীয়া: নাবীন ডিরেক্টরদের কাজের মান নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
নিপা: নবীন ডিরেক্টরদের মধ্যে অনেকেই খুব ভালো করছেন। নতুন নতুন মুখ নিয়ে কাজ করছেন।
জাগরণীয়া: আমরা বারবার পরিবর্তনের কথা বলি, বাস্তবে আমাদের নাটকে কি মানগত ভাবে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে?
নিপা: পরিবর্তন একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যেভাবে পরিবর্তনের কথা বলা হয় সেভাবে মানগত পরিবর্তন এখনো আসেনি। বাজেট স্বল্পতা, দ্রুত এবং দায়সারাভাবে কাজ করার অপেশাধারী মনোভাব, ভালো স্ক্রিপ্টের অভাব, নকলের প্রবনতা ইত্যাদি নানারকম সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কাজের মানে কোন হেরফের দেখা যায়না। দুএকজন এত প্রতিকুলতার মাঝেও ভালো কাজ বের করার চেষ্টা করেন।
জাগরণীয়া: নতুন যারা অভিনয়ে আসতে চাচ্ছে তাদেরকে কি কি পরামর্শ দেবেন?
নিপা: নতুনদের প্রতি উপদেশ থাকবে তারা যেন ভালোবেসে কাজটা শিখে এখানে কাজ করতে আসে। আর অবশ্যই ধৈর্য রেখে সাবধানে পথ চলার জন্য উপদেশ থাকবে।
জাগরণীয়া: ভিনদেশীয় সিনেমা বা গল্প থেকে গল্প চুরির যে প্রবণতা এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
নিপা: এটা পুরোপুরিই ব্যক্তির সদিচ্ছার অভাবের ওপর নির্ভর করে। এমন তো না যে আমাদের দেশে প্রতিভার অভাব বা স্ক্রিপ্ট পাওয়া যায়না। ভালো মেধাবী অনেক স্ক্রিপ্ট রাইটার আছেন কিন্তু তাদের মেধাকে ঠিকমত কাজে লাগানো হয়না। নকলের প্রবণতা শুধুই একটি শর্টকাটে কাজ শেষ করার মনোবৃত্তি।
জাগরণীয়া: শুধু টাকা থাকলেই কি টেলিভিশন মাধ্যমে প্রযোজনায় আসা উচিত? নাকি টাকার সাথে আরো কিছু যোগ্যতা থাকা জরুরী মনে করেন?
নিপা: টাকা থাকার পাশাপাশি অবশ্যই কিছু যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তির প্রযোজক হিসেবে আসা উচিত। কেননা যেকোন ধরণের ব্যবসায়ীর হাতে প্রচুর টাকা থাকতে পারে কিন্তু তার মিডিয়া বা এখানকার কাজ সম্পর্কে কোন ধারণা থাকেনা। শুধুই বিনিয়োগ এবং বিনোদনের জায়গা হিসেবে মিডিয়াকে বেছে নিয়ে লাভ করার প্রবণতা থেকেই কম টাকায় কাজ করে বেশি টাকায় সেটাকে চ্যানেল এ বিক্রী করার মানসিকতা রয়ে যায়। আর যখন একজন প্রযোজকের মিডিয়া সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা থাকবে তখন তিনি লাভের পাশাপাশি এখানকার কাজের মান উন্নত করার চিন্তা করবেন, নতুনত্ব আনার কথা ভাববেন। আর অবশ্যই একজন প্রযোজকের নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
জাগরণীয়া: কার কার অভিনয় আপনাকে প্রভাবিত করে?
নিপা: হলিউডের মেরিল ষ্ট্রিপ, জনি ডেপ, টম হ্যাংকস, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, জুলিয়া রবার্টস, বলিউডের ইরফান খান, নাসিরুদ্দিন শাহ, আমির খান, বিদ্যা বালান, নওয়াজউদ্দীন বাংলাদেশে হুমায়ুন ফরিদী, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মোস্তফা, নুসরাত ইমরোজ তিশা এদের অভিনয় আমাকে বরাবরই অনুপ্রাণিত করে। বর্তমানে আরফান নিশোর কিছু কাজ ভালো লাগছে।
জাগরণীয়া: অভিনেত্রী নিপাকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?
নিপা: অভিনেত্রী নিপা এখনো নাদান বাচ্চা। ভবিষ্যতে তাকে আরো পরিনত এবং শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে দেখতে চাই।
জাগরণীয়া: আমাদের টিভি নাটক নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?
নিপা: আমাদের টিভি নাটকে আমি সেই স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তন দেখতে চাই। দর্শক আবার টিভির সামনে অপেক্ষা করে বসে বসে সবাই মিলে বাংলাদেশী নাটক দেখবে, নাটকের চরিত্র কে নিজেদের মানুষ বলে ভাববে তাদের সুখ, দুঃখ নিজেদের সুখ, দুঃখে রুপান্তর করবে। তাদের জন্য আবেগে রাস্তায় নেমে যাবে। কল্পনায় আমি সেই ৯০ দশকের দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই।
জাগরণীয়া: সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নিপা: আপনাকেও ধন্যবাদ।