কারিগরি শিক্ষায় পিছিয়ে মেয়েরা
প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০১৬, ১৫:১১
সাধারণ শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ও সফলতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে না।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, কারিগরি খাতে মেয়েদের জন্য পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। এজন্য কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহের অভাব এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে দায়ী।
কারিগরি খাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নেওয়া হয়েছে বেশকিছু পরিকল্পনা। প্রতিটি বিভাগে কাজ চলছে মহিলা পলিটেকনিক স্থাপনের। ভর্তিতে ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ কোটা চালু করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যবস্থা করা হয়েছে শিক্ষা বৃত্তির। কিন্তু ফল পাচ্ছে না সরকার।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদদের পরামর্শ, সচেতনামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু কারিগরি খাতের সঙ্গে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিষয়টি জড়িত, তাই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষাবিষয়ক পরিসংখ্যানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যানবেইসের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কারিগরিতে বর্তমানে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যেখানে সাধারণ শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশের বেশি। আর সরকারের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় মোট ৮ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার ৮৭০। এ ছাড়া ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কারিগরি শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ। তবে ইউসেপ বাংলাদেশের এক জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ৩৮ শতাংশ।
আর কারিগরি শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ৭ শতাংশ বলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
২০১৫ সালে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্রীদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা চালু করে সরকার। যেখানে আগে এই হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ চলতি শিক্ষাবর্ষে এই ২০ শতাংশ কোটা অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পূরণ হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী জানিয়েছেন, দেশের সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে গত ১৬ জুন অনুষ্ঠিত ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার ৪৫৬টি প্রতিষ্ঠানে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯১৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৮২ জন ছাত্রের বিপরীতে ছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ২১ হাজার ৩৩৬ জন।
সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কর্মমুখী এ শিক্ষায় জোর দেওয়া হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির জন্য কারিগরি শিক্ষার পরিসর বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৩ শতাংশ কারিগরি শিক্ষা নিচ্ছে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার এনরোলমেন্ট ২০ শতাংশে ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রা ৬০ শতাংশ।’
এ লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রতি বিভাগে মহিলা পলিটেকনিক স্থাপনের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ৭ হাজার ৭৭০টি। এর মধ্যে ১১৯টি সরকারি। সরকারিভাবে ছাত্রীদের জন্য ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় চারটি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট আছে। ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতে আরো তিনটি ইনস্টিটিউট ও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে মেয়েদের টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
এদিকে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ঘুরে-ফিরে কিছু বিষয়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ও চাহিদাসম্পন্ন কিছু কোর্সে মেয়েদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।
ব্যানবেইসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কারিগরিতে গ্লাস ও সিরামিক বিষয়ে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়েরা পড়ছে মাত্র ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। জরিপ শিক্ষায় ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ, গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ মেয়েরা পড়ালেখা করছে।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অশোক কুমার বিশ্বাস জানান, কারিগরিতে বর্তমানে ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ বা ২৫ শতাংশ ছাত্রী। সরকারি ১১৯টি প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা আছে। তবে সব ক্ষেত্রে এ কোটা পূরণ হচ্ছে না।
কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতাও তৈরি হয়েছে। তারপরও সংখ্যা কমতে থাকা মানে হলো অগ্রগতির ধারায় ছেদ পড়া। সংখ্যা কমার পেছনে ছাত্রীদের আবাসন ও যাতায়াত সমস্যা একটি কারণ হতে পারে।’
এদিকে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়, দেশের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ানোর পাশাপাশি নারী শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর ‘ক্যারিয়ার অ্যাডভাইস ডেস্ক’ স্থাপন করা প্রয়োজন। এ ডেস্কের মাধ্যমে নারী শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার কারণ কী, এ বিষয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ রয়েছে কি না জানতে চাইলে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষা আসলে মেয়েদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। তারা পার্টিকুলার (বিশেষ) কিছু টেকনোলজি (প্রযুক্তি) প্রিফার (পছন্দ) করে। সবগুলো বিষয় প্রিফার (পছন্দ) করে না। তারা আসলে তাদের উপযোগী বা কমফোর্ট ফিল (সুবিধাজনক মনে করে) করে এমন বিষয় বাছাই করে।’
কারিগরি শিক্ষায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, কারিগরিতে মোট শিক্ষার্থী বাড়লেও ছাত্রীদের শতকরা হার কমছে। এটা ঠিক, আমরা নারীদের পর্যাপ্ত আকর্ষণ করতে পারিনি।’