আলো ছড়ানো এক শিক্ষক দম্পতির গল্প
প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০১৯, ২০:০০ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৯, ২০:১০
চারপাশ পানিবেষ্টিত হাওর দ্বীপ অষ্টগ্রাম। এই গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার পর ঝরে পড়তো বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই। মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে সদর ও আশেপাশের ইউনিয়নে কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম “অষ্টগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়” যা বর্তমানে “অষ্টগ্রাম সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়” নামে পরিচিত।
১৯৬৯ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন একজন শিক্ষক, শ্রদ্ধেয় নির্মল চন্দ্র সাহা। যিনি শুরু করেছিলেন শিক্ষার আলোয় হাওর এলাকার মানুষগুলোকে আলোকিত করার সংগ্রাম। এর মাঝে শুরু হয় বাঙালির মুক্তি আদায়ের সংগ্রাম, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। নিজের দেশকে স্বাধীন করতে তিনি যোগ দেন সম্মুখ সমরে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হারিয়েছেন নিজের একমাত্র বসতভিটা। তারপরও নিজের ভাইকে নিয়ে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনেন প্রিয় বাংলাদেশের সম্মান। যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে আসেন হাওরের মানুষগুলোর কাছে। আলোর হাত বাড়িয়ে দেন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিকে। স্বাধীন দেশে আবারও শুরু করেন শিক্ষার আলোয় মানুষকে আলোকিত করার সংগ্রাম...
১৯৭৬ সালে শ্রদ্ধেয় হেনা রায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রীও একই বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। বিদ্যালয়ের ঠিক পাশেই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করেন।
শিক্ষক যে কতটা আপন হতে পারে, কতটা পরম মমতা নিয়ে পড়াতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ছিলেন তারা দুজন। আলোকিত মানুষদের চিনতে ভুল করেনি আমাদের অষ্টগ্রামের মানুষ। তাই তো অভিভাবকদের আস্থা ও শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার মানুষ হয়ে ওঠেন অতি অল্প সময়ে। শুধু শিক্ষার্থী বা অভিভাবকই নয়, অষ্টগ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে তারা দুজন হয়ে উঠেন প্রাণ প্রিয় নির্মল স্যার ও দিদিমণি।
অষ্টগ্রামের বড় বাজারে তাদের একটি বইয়ের লাইব্রেরি রয়েছে। যেখান থেকে বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম দিয়ে সাহায্য করতেন আর্থিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের। সারাদিনই তাদের বাড়িতে থাকতো ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা। বিদ্যালয়ে কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে চিকিৎসাকালীন সময়টা এই বাড়িতেই থাকতেন শিক্ষার্থীরা। অষ্টগ্রামের শিক্ষা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র বলা হত বাড়িটিকে। নিজেদের উপার্জনের সিংহভাগ আমৃত্যু এই শিক্ষক দম্পত্তি ব্যয় করে গেছেন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য। দরিদ্র, অবহেলিত, শিক্ষাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের একমাত্র ভরসা ছিলেন এই নির্মল স্যার ও দিদিমণি। দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান, প্রিয় স্কুল আর প্রিয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভালই কাটছিলো সময়।
সময় গড়িয়ে তখন ২০১৪ সাল। জুলাই মাসের প্রথম দিন, হুট করেই আসে এক অজানা ঝড়! কে জানতো সারা জীবন শিক্ষার আলো ছড়ানো এই দম্পত্তির জীবনের আলো অকালেই নিভে যাবে! সারা জীবন মানুষের মাঝে আলো ছড়িয়ে গেছেন, অক্লান্ত চেষ্টা করেছেন হাওর অধ্যুষিত এই অঞ্চলের মানুষগুলিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোর হাতছানি আর আলোর মুখ দেখেতে পারে নি। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা আকষ্মিকভাবে তাঁদের কেড়ে নেয় আমাদের কাছ থেকে।
এই শিক্ষক দম্পতি যতদিন বেঁচে ছিলেন, তৈরি করে গেছেন অসংখ্য আলোকিত মানুষ। যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। যেদিন মহান এই শিক্ষক দম্পত্তির মৃত্যুসংবাদ ভেসে আসে, সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে ওঠে। স্যার ও দিদিমণিকে সমাহিত করা হয়েছে তার প্রিয় গ্রামের বাড়িতেই। কিন্তু তারা বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে, আমাদের হৃদয়ে।
কিছু মানুষ রয়েছেন যাদের মৃত্যুই তাঁদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয় না, বরং শুরু হয় উজ্জ্বল ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। যা পথ দেখায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
আজ জুলাই মাসের প্রথম দিন পরম শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করি মহান এই মানুষদের।
ভালো থাকুন পরপারে প্রিয় নির্মল স্যার ও প্রিয় দিদিমনি।