শৈশব ও বৈষম্যের শিক্ষা

প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:২৬

৯০ এর দশকে আমরা যারা কিন্ডার গার্টেনে পড়তাম তখন ইউনিফর্ম ছিল শার্ট, প্যান্ট/স্কার্ট, টুপি, টাই, জুতামোজা এই। ছেলেমেয়ের মধ্যে শুধু প্যান্ট আর স্কার্ট এটুকুই পার্থক্য ছিল, কিন্তু সেটা খুব একটা বোধগম্য ছিল না। আমার ছোট্টবেলার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল শাহান। আমরা একই বিল্ডিং এ থাকতাম, একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম। শাহান একটু বোকাসোকা ছিল বলে তার মা আমার হাতেই তার হাত ধরিয়ে দিয়ে বলতেন ওকে দেখে রেখো। আমরা হাত ধরাধরি করে স্কুলে যেতাম, ক্লাসে পাশাপাশি বসতাম, আবার ছুটি হলে হাত ধরেই দৌড়তে দৌড়তে বাসায় ফিরতাম। শুধু আমি না আমার বয়সী কিংবা বড় ছোট অনেকেরই নিশ্চয়ই এই ধরণের স্মৃতি থাকবে। সেই বয়সে ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবার মতো কিছু আসতো না মাথায়। পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানো তো দূরের কথা। স্কুলেও শিখতাম আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, কিংবা শাপলা, গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা এসব। খেলার মাঝেও থাকতো ওপেনটি বায়োস্কোপ, গোল্লাছুট, রুমাল চুরি। ছেলে মেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম না এমন না, কিন্তু সেটা কোন ইস্যু ছিল না আমাদের কাছে। কারণ লেখাপড়া, খেলাধুলা কোন ক্ষেত্রেই এটা নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না।

কিছুদিন আগেও একটি বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কিভাবে ছোট ছোট বাচ্চাদের পোশাক কেনার সময়ও মানুষ জিজ্ঞেস করে ছেলে বাচ্চার? নাকি মেয়ে বাচ্চার? ১ বছরের শিশুর জুতা কিনতে গিয়ে ভাবে ছেলেদের জুতা? নাকি মেয়েদের জুতা? আমরা তো ছোটবেলায় পড়েছিলাম শিশু, সন্তান এসব উভয়লিঙ্গ। যদি তাই হয় তবে ছোট্ট একটি শিশু, যার মস্তিষ্কের গঠনই এখনো পূর্ণ হয়নি তাকে তার লিঙ্গ দিয়ে ভাবা শুরু করাটা আদৌ কতটুকু যৌক্তিক? লিঙ্গ কি আসলেই গোপনাঙ্গের উপরেই নির্ভরশীল? মস্তিষ্কের উপরে নয়? আর তাই যে ছেলেটি মেয়েদের মতো সাজতে চায় আমরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করি, যে মেয়েটির চলাফেরায় লাজুকলতা ভাব নেই তাকে নিয়ে সমালোচনা করি। আর ঠিক এই পরিবেশে একটি শিশুকে বড় করে পরে যখন ছেলেটি ধর্ষক হয়ে উঠে, জঙ্গি হয়ে উঠে আর মেয়েটি হয়ে উঠে শরীরসর্বস্ব প্রাণী তখন আমরা অবাক বিস্ময়ে বলি, এই ছেলে কিভাবে এমন করলো? এই মেয়ে এমন কেন? আপনি যদি মেয়ে শিশুকে কেবল রান্নাবাটি আর পুতুল খেলতেই শেখান, তার পোশাকে যদি কেবলই থাকে সুন্দরী হবার চিন্তা, তাকে যদি সাইকেল চালাতে না শেখান, প্যান্ট পরে দৌড়াতে না শেখান, সে যতোই শিক্ষিত হোক, মনোজগতে তার সংসার ছাড়া অন্য কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরী হবে না, সে জীবনের স্বাদ গ্রহণকে শারীরিক সৌন্দর্যের আগে স্থান দিতে পারবে না। 

আমাদের দেশে এই যে এতো সমস্যা, লিঙ্গ বৈষম্য বলুন, জঙ্গিবাদ বলুন এর সবকিছুর মূলে সেই শিক্ষা ব্যবস্থা। যতোদিন পর্যন্ত আপনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থ, ধর্মীয় স্বার্থ থেকে আলাদা না করতে পারবেন ততদিন পর্যন্ত চিন্তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর চিন্তার পরিবর্তন যদি না আসে তাহলে কতিপয় ধর্ষককে শাস্তি দিয়ে কিংবা জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে এই সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব নয়। এমনকি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাও এর চূড়ান্ত সমাধান নয়। কারণ শাস্তির ভয়ে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকার চেয়ে নৈতিকতার বলে অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত হওয়াটাই বরং অধিক শ্রেয়। তো এই নীতিবান প্রজন্ম যে আপনি তৈরি করবেন, যে হত্যা করবে না, ধর্ষণ করবে না, বৈষম্য করবে না, সেই প্রজন্ম তো হুটহাট কয়েকটা কর্মশালা কিংবা সেমিনারে তৈরি করা যাবে না। এটা একটা প্র্যাকটিসের ব্যাপার। আর এই প্র্যাকটিস যদি ছোটবেলা থেকে না হয় তাহলে পরবর্তীতে আর সম্ভব নয়। একজন মানুষ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। কিন্তু শৈশব কৈশোরে তার অন্তর্নিহিত যে সত্ত্বা সেটাকে আমূল পরিবর্তন করা যায় না।

এই কথাগুলো বলছি এই কারণে যে, এবছর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রথম শ্রেণীর যে বই ছাপানো হয়েছে সেখানে 'ও' দিয়ে শব্দ লেখা হয়েছে 'ওড়না' এবং তার সাথে বাক্য দেয়া হয়েছে 'ওড়না চাই'। আমরা বর্ণশিক্ষার বইয়ে 'ও' দিয়ে পড়েছিলাম, 'ওল খেয়ো না ধরবে গলা'। আগেই বলেছি ছোটবেলার পড়ার একটা বড় অংশ ছিল ছবি দেখে দেখে নানারকম ফুল, ফল, পাখি, মাছ এসবের নাম জানা। আমাদের খেলাও ছিল 'নাম-দেশ-ফুল-ফল' কিংবা 'বি কুইক, নেমস অফ ফ্লাওয়ার্স' এসব। কে কার চেয়ে বেশি ফুলের নাম, ফলের নাম, পাখির নাম জানি সে নিয়েই ছিল প্রতিযোগিতা।  এই ফুল, ফল, পাখি, মাছ, দেশ একটি ছেলে শিশুর কাছে যেভাবে ধরা দেয়, একটি মেয়ে শিশুর কাছেও তাই। কিন্তু যখনই আপনি এই শৈশবের শিক্ষায় এমন কিছু যোগ করছেন যা সব শিশুর কাছে সমানভাবে ধরা দিচ্ছে না তখন সেটি শিক্ষার ব্যত্যয়। কারণ শিক্ষা মানেই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষ, লিঙ্গ নিরপেক্ষ, বৈষম্যহীন। যেমন ধরুন, 'ম' দিয়ে যদি শব্দ শেখানো হয় মসজিদ আর বাক্য বলা হয় মসজিদে যাই, তাহলে সেটি কিন্তু সব শিশুর কাছে সমান অর্থ নিয়ে আসছে না। কারণ যে শিশু মসজিদে যায় না তাকেও যখন বলতে হয় 'মসজিদে যাই', তখন সেটা তার মনোজগতে প্রভাব ফেলে। আপনি বুঝতে পারবেন না, শিশুটিও বুঝাতে পারবে না, কিন্তু সে বুঝতে পারে সে যা করে না তাই তাকে বলতে হচ্ছে। একইভাবে 'গ' দিয়ে যদি শব্দ হয় গীতা, বাক্য হয় গীতা পড়ি, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। কিছুদিন আগে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্রে এরকম একটি সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন হয়েছিল আর সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনাও হয়েছে।

অনেকেই এই ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে বলছেন, ছেলেরাও আজকাল পাঞ্জাবির সাথে ওড়নার মতো কিছু একটা পড়ে। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, এটা সার্বজনীন নয়। কিন্তু ওড়না পরাটাকে মেয়েদের জন্য সামাজিকভাবে সার্বজনীন হিসেবে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ মেয়ে হলে সে ওড়না পরে কিংবা তাকে পরতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যে ছবিটা দেয়া আছে সেটিও একটি মেয়ের যে ওড়না চাইছে। অর্থাৎ অবচেতনভাবেই বুঝানো হচ্ছে ওড়না পোশাকটি মেয়েদের এবং একটি মেয়ে ওড়না চায়, মানে সেটা তার কাছে আকাঙ্ক্ষিত কিছুই। অর্থাৎ মেয়ের শরীরের নির্দিষ্ট একটি অংশ ঢেকে রাখার জন্য এই ওড়না খুবই প্রয়োজনীয় কিছুই। অনেকে আবার এটাও বলছেন বইয়ে না পড়লেও বাচ্চারা তো ওড়না চিনে। হ্যাঁ চিনে, কিন্তু সেখানে কেউ তাকে বারেবারে ওড়না বানান করো, কিংবা একটি মেয়ের ছবি দেখিয়ে এই দেখো মেয়েরা ওড়না পরে, কিংবা মেয়েটির ওড়না চাই এই ধরণের কথা বলেন না। ফলে ওড়না নিয়ে আলাদা করে কিছু ভাবার চিন্তা তারা করে না। যেটা আমি আগেও বলেছি যে আমরাও ছোটবেলায় খেলার সময় আলাদা পোশাক পরেছি, কিন্তু সেটা যে আলাদা এতো কিছু ভাবার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু আপনি যখন একটা শব্দ বারবার একটি শিশুকে বলছেন, বানান করে শিখতে বলছেন সে তখন শব্দটি নিয়ে ভাবছে, সেই ছবিটি নিয়ে ভাবছে, নিজের কল্পনাজগতে সেই ছবিটি আর শব্দটিকে সাজাচ্ছে। যেমন আমরা ভাবতাম অদেখা কোন ফুলের ছবি দেখে যে সেটা কেমন হবে, কিংবা এই ফলটি খেতে কেমন হবে ইত্যাদি। তাই বিষয়গুলোকে আসলে আমরা যতো ছোট করে ভাবি, এতো ছোট নয়। কিংবা হয়তো ছোটই আর এই ছোট ছোট ঘটনাগুলোই বড় ধরণের ধাক্কা হয়ে আসে। যারা ছোটবেলায় বইপত্রে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনী পড়েছেন তারা নিজেরাও জানেন এ নিয়ে কখনো কোন কথা না বললেও অন্য ধর্মের শিশুদের সেটা ভেতরে ভেতরে কিছুটা হলেও হীনমন্যতার জন্ম দিতো। ধর্ম ক্লাসে যখন ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আলাদা হয়ে যায়, তখন মনে হয়, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিও আসলে আমার চেয়ে আলাদা কিছু। তাই এই ওড়না চাই এই ধরণের বাক্য, কিংবা সৈকত হিন্দু নাকি মুসলিম এরকম প্রশ্নকে স্রেফ বিচ্ছিন্ন কিছু বা ছোট একটি ঘটনা বলে ভাবার সুযোগ নেই। কারণ আপনার আমার কাছে যা ছোটখাটো ব্যাপার, শিশুদের কাছে হয়তো সেটিই বিশাল কিছু। আর এই ছোট ছোট ঘটনাতেই হয়তো তার মনোজগতে বিস্তর প্রভাব পড়ছে, কারণ এই সময়েই তার চিন্তাজগত তৈরী হচ্ছে।

যে কথাটা আগেই বলেছি আবারো বলছি, শিক্ষা মানেই সেটা ধর্ম নিরপেক্ষ, লিঙ্গ নিরপেক্ষ, বৈষম্যহীন। আপনি যখন সেখানে বৈষম্যের দেয়াল তুলে দিচ্ছেন, মানুষ হওয়ার আগেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কে নারী, কে পুরুষ, কে হিন্দু কে মুসলিম তখন সেটা আর শিক্ষা থাকছে না। এই শিক্ষা নামক কুশিক্ষা আর যাই হোক, মানুষের মানুষ হবার পাথেয় হতে পারে না। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থায় আপনি শেখাতে পারবেন না মায়ের কাজ রান্না করা, ঘর গুছানো, বাবার কাজ বাজার করা ইত্যাদি ইত্যাদি। বরং শেখাতে হবে এসো রান্না করি, কিংবা সবাই মিলে ঘর পরিষ্কার রাখি। আমরা তো আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থায় এখনো বৈষম্য দূর করতে পারিনি। এমন কোন পরিবারও নেই যেখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালিত হয় না। আমরা আমাদের মেয়ে শিশুকে ফুটবল খেলতে বলি না, কোন যন্ত্রপাতি পরিচালনা করতেও শেখাই না। ছেলে শিশুটিকেও শেখাই না তার নিজের টিফিন বক্স, নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে, ঘরের কাজে সহায়তা করতে। মেয়ে শিশুকে গুছানো স্বভাবের হতে হবে, ছেলে হবে অগোছালো এটাই যেন নিয়ম। এইসব কিছুর সাথে এখন নতুন করে আমরা জুড়ে দিয়েছি শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈষম্য শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া। 

আমরা এমনই এক সমাজব্যবস্থায় বেঁচে আছি, যেখানে কৈশোরে পা দিলেই একটি মেয়ে জেনে যায় সে ধর্ষিত হতে পারে যখন তখন, একটি ছেলে যৌনশিক্ষা পাওয়ার আগেই জেনে যায় তার শরীরের বিশেষ অঙ্গটি কারো ভেতর ঢুকিয়ে দিলেই তার 'সর্বনাশ' করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করার আগেই মেয়েটি জেনে যায় তার জন্য বরাদ্দ রয়েছে নির্দিষ্ট ধরণের কিছু চাকরি, কিংবা সংসার। ছেলেটিও জেনে যায় যেহেতু সে 'পুরুষ' তাই তাকেই টানতে হবে সংসারের ঘানি, তাই যেনতেন করেই হোক চাই লাভজনক চাকরি। রাজনৈতিক অসাম্য, মৌলবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য, পুঁজিবাদী আগ্রাসন এই সবকিছুই জাপ্টে ধরে আমাদের তরুণদের। জীবিকার লড়াই এর সাথে এই সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে আমরা একসময় হতাশ হয়ে ভাবি, আমাদের জীবন তো গেলো, আমাদের পরের প্রজন্ম কী একটা বাসযোগ্য পৃথিবী পাবে? আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর, বৈষম্যহীন জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি, অন্তত একটা বৈষম্যহীন শৈশব কি তাদের দিতে পারি না?