সহি ইসলাম কিংবা সহি পুরুষত্ব ও আমাদের দায় এড়ানোর সংস্কৃতি
প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:৪৫
নারীবাদ এর সঠিক মানে না জানার কারণে একে অনেক পুরুষই পছন্দ করেন না। এমনকি অনেক প্রগতিশীল পুরুষও। তারা এটাকেও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের পথে একটা বাধা হিসেবে দেখেন। যদিও নারীবাদ মানে যেখানে স্রেফ নারীকে মানুষ ভাবা সেক্ষেত্রে আমি নারীবাদের সাথে মানবতাবাদ এর আসলে কোন কনফ্লিক্ট দেখি না।
যাই হোক, এই নারীবাদকে পছন্দ না করার ব্যাপারে একটা বড় যুক্তি থাকে এই যে সব পুরুষ এক না, বা সমান না। হ্যাঁ আমি মানছি সেটা। পৃথিবীতে এখনো অনেকে আছেন যারা পুরুষ হবার আগে মানুষই হন। কিন্তু কথা হচ্ছে সার্বিক অর্থে বা মোটা দাগে এই সংখ্যাটা কতো? এরা কি পুরুষ সমাজে সংখ্যাগুরু নাকি সংখ্যালঘু? যদি কেবল সংখ্যালঘুই হন, কেবল ব্যতিক্রমই হন, তবে কি আপনি বা আপনারা আদৌ পুরো পুরুষ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন?
যারা ধর্ষক পুরুষদের জন্য সব পুরুষের উপর নারীদের বিরক্তি বিদ্বেষ এর প্রতিবাদ করেন, তারা নিজেরাও কি কোন জাতি, গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে একটা জেনারেলাইজ ধারণা পোষণ করেন না? করেন। জঙ্গিবাদ ইস্যুতে পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপরীতে, রামপাল, তিস্তা ইস্যুতে পুরো ভারতের বিপক্ষে, একাত্তর ইস্যুতে পুরো পাকিস্তানের বিপক্ষে, সাম্রাজ্যবাদ ইস্যুতে আমেরিকার বিপক্ষে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে পুরো ইহুদী জাতির বিপক্ষে এরকম নানা ইস্যুতে এদের একটা জেনারেলাইজ বক্তব্য পাওয়া যায় কারো বিরুদ্ধে।
তাহলে আজকাল যা ঘটছে তার প্রেক্ষাপটে একজন নারী যদি পুরো পুরুষ সমাজের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন তার দায় কার? ভালোবেসে যার সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখে একটি মেয়ে সেই প্রেমিক পুরুষটি যখন সেক্স ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে লক্ষকোটি মানুষের কাছে মেয়েটিকে স্রেফ পণ্য করে তোলে তখন সেই মেয়েটি তার পুরো জীবন সকল পুরুষের প্রতি ঘৃণা নিয়ে কাটিয়ে দিলে সেই দোষ কার?
মাত্র ১২ বছর বয়সে আমি দেখেছি পুরুষের কদর্য রূপ। তারপর পুরো পুরুষ সমাজের প্রতি আমি ঘৃণা লালন করতে শুরু করেছিলাম। প্রথম প্রথম তো ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় কোন পুরুষ দেখলেই আমার রাগে মাথায় আগুন ধরে যেতো, মুখে জমতো একদলা থুথু। বাড়িয়ে বলছি না, সত্যি তাই ঘটতো। এমনকি নিজের বাবার স্পর্শেও আমার গা ঘিনঘিন করতো। ৪টা বছর আমি এভাবেই কাটিয়েছি। যদি পরবর্তীতে আমি এমন কোন পুরুষের সংস্পর্শে আসতে না পারতাম যে কেবল পুরুষ নয়, মানুষ তাহলে আজো আমি নিশ্চয়ই সব পুরুষকে ঘৃণা করেই বাঁচতাম। আমার সৌভাগ্য আমি পরবর্তীতে কিছু বন্ধু পেয়েছিলাম, কিন্তু সবাই কি পায়?
জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যেমন 'ইহা সহি ইসলাম নয়' বলে মুসলিমরা দায় শেষ করতে পারেন না, বরং তাদেরই দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার, সারা বিশ্বে মুসলিমদের অপরাধের বিপরীতে নিজেদের মানবিক অবস্থান তুলে ধরার; তেমনি সারা পৃথিবীতে নারীর প্রতি বৈষম্যের, নারীকে পণ্য বানানোর প্রক্রিয়ার, ধর্ষক পুরুষদের বিপরীতে নিজেদের মানবিকতার দৃষ্টান্ত দিতে হবে পুরুষকেই। নইলে শুধুমাত্র 'সব পুরুষ এক নয়' বলে দায় এড়ানো সম্ভব নয় আর।
নিশ্চয়ই নারীবাদ মানেই পুরুষবিদ্বেষ নয়, কিন্তু কোন নারী পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে নারীতন্ত্র নিয়ে কেন হাজির হচ্ছেন সেটা খুঁজে দেখার দায় সবচেয়ে বেশি কিন্তু পুরুষদেরই। এই নারীরা হয়তো সারাজীবন শরীরে হাত দেয়ার মতো অনেক পুরুষ দেখেছেন, কিন্তু মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ কিংবা ভালোবাসা, স্নেহ দেখানোর মতো কাউকে পাননি। যারা কেবল পুরুষ না হয়ে মানুষ হবার চেষ্টা করেন, তারা কি এই কারণগুলো খুঁজে বের করবেন? তাদের স্নেহে, মমতায়, আশীর্বাদে এই নারীদের বুঝাতে পারেন যে পৃথিবী এখনো পুরোপুরি অমানুষের গ্রাসে চলে যায়নি? নাকি কেবল এই নারীদের পুরুষবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে নারীবাদকে মানবিক সমাজ গঠনের পথে অন্তরায়, বা অপ্রয়োজনীয় বলে দায় সারবেন? মনে রাখবেন, আপনার উত্তরই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে কোন একদিন, আপনার কাছে না হলেও আপনার সন্তানের কাছে।