সব রূপা-ই কি বিচার পাবে?
প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:০৯ | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:৩৩
অপরাধের নিশ্চয়ই ছোট বড় হয় না। প্রতিটি ধর্ষণই অন্যায়, প্রতিটি প্রাণহানিই সমান বেদনার। ৬ মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধা অবধি যেকোনো বয়সের, যেকোনো ধর্মের, যেকোনো অবস্থানের, যেকোনো পেশার নারীদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার খবর নিয়ে প্রতিদিন কাজ করতে করতে আমরাও বিমর্ষ হয়ে পড়ি। তবু এর মাঝেও কিছু ঘটনা থাকে যা আমাদের রাগ, ক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। আমরা ক্ষুব্ধ হই, ক্রুদ্ধ হই। তারপর দেখতে দেখতে ক্লান্ত হই, বিমর্ষ হই।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, আরো অনেকের মতোই একটা স্বাভাবিক দিন ছিল সেদিন রূপার। বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে রাতে ফিরছিলেন নিজের কর্মক্ষেত্র শেরপুরে। অথচ সেই এক রাতে সব উলট পালট হয়ে যায় রূপার জীবনে। রূপার পরিবারের জন্যও আর কখনো জীবন আগের মতো হয়নি। চলন্ত বাসেই বাসের হেলপার, চালক এর ধারালো থাবার নিচে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয় রূপা। পড়ে থাকে বেওয়ারিশ হিসেবে রাস্তায়। বেওয়ারিশ হিসেবেই দাফন হয় তার। হয়তো কাগজের কোণে পড়ে থাকা আরো অনেক অজ্ঞাত লাশের খবরের মতোই হারিয়ে যেতো সে যদি বড় ভাই ছুটে না আসতো পত্রিকায় ছবি দেখে।
রূপার এই ঘটনা আমাকে এবং আমার মতো আরো অনেককেই একদম সমূলে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেমন নাড়া দিয়ে গিয়েছিল তনু কিংবা পূজা। ঐ ঘটনাগুলোর মতোই রূপার ঘটনার পর আমি বহুদিন রাতে ঘুমাতে পারতাম না। একটা বাস চলছে, আর সেখানে অসংখ্য নেকড়ে হায়েনা খুবলে খাচ্ছে আমাকে এমন দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরেছে। ছোট ছোট স্পর্শেও তখন রীতিমত আঁতকে উঠেছি। কাজের সূত্রে প্রায়ই রাতের অন্ধকারে একা ফিরতে হয়, ফিরতে হয়েছে তখনো। আমি শুধু ভেবে গেছি এমন জঘন্য একটা পৃথিবীতে আমি এখনো ধর্ষিত হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থেকে পচে গলে যাইনি সেই ভীষণ আশ্চর্যের!
আজ রূপার ধর্ষক ও হত্যাকারীদের রায় হয়েছে। সেখানে ৪ জনকেই ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বাসের সুপারভাইজার পেয়েছে ৭ বছরের কারাদণ্ড। রূপার বড় ভাই, যিনি পত্রিকায় নিজের আদরের বোনের ছবি দেখে ছুটে গিয়েছিলেন, তিনি জানিয়েছেন রায়ে তিনি সন্তুষ্ট। টাঙ্গাইলবাসীও জানিয়েছে এই রায়ে তাদের সন্তোষের কথা। নিশ্চয়ই আরো অনেকেই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন আজ। আমারো মনে হচ্ছে যাক অন্তত রূপা তো বিচার পেলো!
কিন্তু পরক্ষণেই ভাবছি, এই যে বিচার এতে কি আসলেই এ সমাজ পাল্টাচ্ছে? এই রূপা না হয় বিচার পেলো, কিন্তু আরো অসংখ্য রূপারা সবাই কি বিচার পাচ্ছে? প্রায় দুই বছর হতে চললো, তনুর হত্যার আজো কোন কূলকিনারা হয়নি। ছোট্ট শিশু পূজার ধর্ষক সাইফুল, কোথায় সে এখন? সে কী আবারো কোন শিশুর কোমল দেহকে ব্লেড দিয়ে কেটে রক্তাক্ত করার পাঁয়তারা করছে? বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা সেই নরপিশাচদেরই বা কি খবর? ৫৪ বার পিছিয়েও কেন মেলে না সাগর রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন?
আজ রূপার বিচারের দিনেও খবরে এসেছে যশোরের এক ছোট্ট মেয়ের কথা যাকে মেলায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দিনের পর দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে তাদের বাসারই ভাড়াটিয়া এক যুবক। না মেয়েটি এখনো মারা যায়নি, তবে হাসপাতালের বেডে যে শুয়ে আছে সে আর আগের মানুষটিও নয়। নাটোরের বড়াইগ্রামে ধর্ষক জামিনে ঘুরে বেড়ায় আর বিচার চাইতে সংবাদ সম্মেলন করতে আসা বাবার কোলে ঘৃণায়, লজ্জায় মুখ লুকায় নয় বছরের শিশুকন্যা।
রূপাকে যেভাবে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে ফেলে দেয়া হয় রাস্তার পাশে একই রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। সেই এক ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল পুরো দেশ। প্রধানমন্ত্রী থেকে চাপরাশি, অভিনেতা থেকে শিল্পী, সবাই একযোগে কথা বলেছিল এই নারকীয় পাশবিকতার বিরুদ্ধে। যেদিন নির্ভয়ার আসামীরা শাস্তি পায় সেদিনও স্বস্তি ও আনন্দের ঢল নেমেছিল পুরো দেশ জুড়ে। এমনকি পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশেও শিশু জয়নাব ধর্ষণের ঘটনার পর সংবাদপাঠক প্রতিবাদ জানাতে নিজের শিশুকন্যাকে নিয়ে হাজির হন সংবাদ পড়তে, জনপ্রিয় অভিনেত্রীরাও সামিল হন প্রতিবাদে। অথচ ভৌগোলিক সামান্য দূরত্বে সেই ক্ষোভ, সেই কান্না, সেই আনন্দ সবকিছুই কেন এতো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠে আমাদের জীবনে?
রূপার গণধর্ষণ ও হত্যার পরেও যেমন রাগ আর ক্ষোভের পাহাড় গড়ে উঠতে দেখিনি তেমনি এই রায়ের পরেও নেই তেমন কোন আনন্দাশ্রুর নদী। হয়তো আমরা অমন নির্বিকারভাবে নিজেদের আবেগ অনুভূতিকে কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রাখতে শিখিয়েছি বলেই আমাদের দেশে ধর্ষক সাইফুল, সাফাত, সাদমান, নাঈমেরা জন্মায়। আর তনু, পূজা, রূপা ও আরো অসংখ্য মৃত ও জীবন্মৃত আত্মারা নিভৃতে কাঁদে। রূপার ধর্ষণ ও হত্যার বিচারে স্বস্তি পাই, কিন্তু তনু, পূজা সহ আরো নাম না জানা অনেকের পরিণতি ভেবে শংকিত হই। যেদিন এইসব শঙ্কা দূর করে যেকোনো অন্যায়ের এরকম দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে সেদিনই এই দেশে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। আর তারই হাত ধরে এই দেশ সত্যিকারের মানুষের দেশ হবে। সেই মানবিক দেশের জন্যই বারেবারে দাবি জানাই, আওয়াজ তুলি।