এসো পা বাড়াই (২০ তম পর্ব)
প্রকাশ | ০৫ মে ২০১৭, ০১:১৪
"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"
LEAN IN এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি
আমার মনে হয় এটাই ছিল আমার শোনা সেরা বক্তৃতা। সম্মতিতে আমি চেয়ার থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, সজোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলাম। আমার সহপাঠী ক্যারি ওয়েবার (Carrie Weber), যে আসলেই অত্যন্ত মেধাবী এবং কোনভাবেই প্রতারক নয়, সেও একই কাজ করছিল। অবশেষে কেউ একজন স্পষ্ট এবং সহজভাবে আমি যা অনুভব করি, ঠিক সেই কথাগুলোই বললো। প্রতিবার যখন ক্লাসে আমাকে ডাকা হতো, আমার নিশ্চিত ভাবেই মনে হতো, আমাকে বিব্রত হতে হবে। প্রতিবার পরীক্ষা দিয়ে আমার মনে হতো, পরীক্ষা ভালো হয়নি। আর প্রতিবার যখন আমি নিজেকে বিব্রত করিনি বরং অনেক বেশি ভালো করে ফেলতাম, তখন আমার ধারণা হতো আমি আবারও সবাইকে বোকা বানালাম। মনে হতো, খুব শীঘ্রই একদিন এই প্রতারণা প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
অভিষেক অনুষ্ঠানের পরপরই হয়েছিল যৌথ অভ্যর্থনার অনুষ্ঠান। এটি ছিল একরোখা প্রযুক্তিবিদের জন্য, যেখানে আমি খুবই মানানসই। ঐ অনুষ্ঠানে আমার এক ছেলে সহপাঠীকে আমি ডঃ ম্যাকিনটশ (Dr.McIntosh) এর চমৎকার বক্তৃতাটির কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম কি সুন্দর করে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে আমরা নিজেকে প্রতারক ভাবি। সে আমার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আর জানতে চেয়েছিল, এটা এত আকর্ষণীয় কেন হবে? ক্যারি আর আমি এই নিয়ে পরে মজা করেছিলাম এইভাবে যে বক্তৃতাটি ছেলেদের জন্য সম্ভবত এরকম, “যেখানে সবাই তোমার মত বুদ্ধিমান নয়, সেই পৃথিবীকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয়”।
যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষের আত্ম-সংশয়ে জর্জরিত এই ভ্রান্ত ধারণার একটি নাম আছে- ছদ্মবেশি উপসর্গ (the impostor syndrome)। নারী পুরুষ উভয়ই এই ছদ্মবেশি উপসর্গ-তে আক্রান্ত হতে পারে, কিন্তু নারীদের বেশি তীব্রভাবে এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আর এটা তাদেরকে আরো বেশি সীমাবদ্ধ করে তোলে। এমনকি দুর্দান্তভাবে সফল লেখক এবং অভিনেত্রী টিনা ফে (Tina Fey) এই অনুভুতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি একবার একটি ব্রিটিশ পত্রিকায় বর্ণনা করেছিলেন, “ইমপসটার সিনড্রোম এর সৌন্দর্য হচ্ছে তুমি দোলায়মান থাকবে চরম তীব্র অহমিকা এবং একটি সম্পূর্ণ অনুভূতির মধ্যে; যে অনুভুতি বলে, 'আমি একজন প্রতারক! ওহ গড, এগুলোই আমার ছিল! আমি একজন প্রতারক!' তাই যখন অহমিকা আসবে তুমি শুধু তাতে চড়ে বসবে আর উপভোগ করবে এবং তারপর প্রতারণার ভাবনাটিকে পিছলিয়ে পার হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে আমি বুঝতে পেরেছি যে প্রায় সবাই প্রতারক, তাই আমি চেষ্টা করি এ নিয়ে বেশি মন খারাপ না করতে"।
নারীদের নিজেদেরকে প্রতারক ভাবা হচ্ছে একটি বৃহত্তর সমস্যার লক্ষণ। আমরা নিজেদেরকে ক্রমাগতভাবে অবমূল্যায়ন করে যেতে থাকি। একাধিক প্রতিষ্ঠানের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীরা প্রায়ই তাদের নিজস্ব কর্মক্ষমতাকে বাস্তবে যা তার চেয়ে নিকৃষ্ট বিবেচনা করে, অন্যদিকে পুরুষরা তাদের কর্মক্ষমতাকে বাস্তবের চেয়ে উত্তম হিসেবে বিচার করে। অস্ত্রোপচার বিদ্যার মূল্যায়ন পরীক্ষায় দেখা যে, ছাত্রছাত্রীদের নিজেদেরকে মূল্যায়ন করতে বললে মেয়েরা নিজেদেরকে কম নম্বর দিচ্ছে ছেলেদের তুলনায়। যদিও শিক্ষকদের মূল্যায়নে দেখা গেছে নারীরা পূরুষদের ছাপিয়ে গিয়েছিল। কয়েক হাজার সম্ভাব্য রাজনৈতিক পদপ্রার্থীর উপর সমীক্ষায় প্রকাশিত যে, তুলনামূলক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি পুরুষ মনে করে তারাই অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন রাজনৈতিক কার্য পরিচালনার জন্য। হার্ভার্ড এর প্রায় একহাজারের মত আইনের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, আইন অনুশীলনে প্রাসঙ্গিক দক্ষতার প্রতি বিভাগে নারীরা নিজেদের কম নম্বর দেয় পুরুষদের চেয়ে। আরো খারাপ হচ্ছে, যখন নারীরা অন্যদের সামনে বা গতানুগতিক পুরুষ আধিপত্যের সামনে নিজেদেরকে মূল্যায়ন করে তখন নিজেদেরকে অবমূল্যায়ন আরো বেশি তীব্র হতে পারে।
(চলবে...)