‘সরকার গোখরো সাপ নিয়ে খেলছে’
প্রকাশ | ১৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৩৩
সরকার সজ্ঞানে গোখরো সাপ নিয়ে খেলছে বলে মন্তব্য করেছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা। শিগগিরই সেই সাপ ছোবল দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী আক্রমণ, অপপ্রচার ও হুমকির প্রতিবাদে এবং সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য অপসারণের জন্য মৌলবাদী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর আত্মসমর্পনের প্রতিবাদে গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।
কেন্দ্রীয়ভাবে গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় এ সমাবেশ। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে সমাবেশে যোগ দেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিশু, ছাত্র, যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশের শুরুতে বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি হাবিবুল আলম। তিনি বলেন, হেফাজতের দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মূলত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে আস্কারা দিচ্ছেন। তিনি সুপ্রীম কোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক নারী ভাস্কর্যকে সরানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের তীব্র সমালোচনা করেন।
প্রকাশক রবীন আহসান বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস মৌলবাদী অপশক্তির কাছে মাথা নত না করার ইতিহাস। হেফাজতিদের দাবির প্রতি ক্ষমতাসীন দল যতো নরমই হোক না কেন, এ গোষ্ঠী কোনদিনই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। তিনি এই বাংলার সব ধর্মের মানুষকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি জিলানী শুভ বলেন, সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তক থেকে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। এরপর তাদের দাবি অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য্য সরানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে এই সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট ষড়যন্ত্রের অংশ। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বিরোধীতাকারী হেফাজতকে প্রশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকার পরোক্ষে জঙ্গিবাদকে মদদ দিচ্ছে কিনা সে প্রশ্নও তোলেন। মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করে অতীতে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, ভবিষ্যতেও কেউ পারবে না বলেও মন্তব্য করেন জিলানী শুভ।
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক জীবনানন্দ জয়ন্ত বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা না করার জন্য হুমকি দেয়া হচ্ছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে কীভাবে এধরনের ঘটনা ঘটে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এসময় প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা করলেও এবছর আওয়ামী লীগ শোভাযাত্রা না করার সিদ্ধান্ত নেয়ার সমালোচনা করেন জীবনানন্দ জয়ন্ত। এছাড়া, কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রির স্বীকৃতি দেয়ার নিন্দা জানান তিনি।
প্রতিবাদ সমাবেশ সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন। সমাবেশের শুরুতে তিনি বরিশালে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের লক্ষ্যে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি, বৈশাখি মেলা বন্ধের হুমকি এবং চট্টগ্রাম চারুকলার শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্র নষ্ট করার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান।
সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবী অনুযায়ী সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দিয়েছে। এখন সেই একই গোষ্ঠীর দাবির প্রেক্ষিতে সরকার সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণ করার কথা বলছে। এটা মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ। সরকার মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও তার উল্টো কাজ করছে। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মদানের মাধ্যমে অর্জিত সকল অর্জনসমূহকে ভূলুণ্ঠিত করে পাকিস্তানী ভাবধারা ফিরিয়ে আনছে এই সরকার বলেও অভিযোগ করেন বক্তারা। তারা আরো বলেন, আজ সুপ্রীম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণের কথা বলছে মৌলবাদীরা, কাল তারা দাবি তুলবে অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য প্রভৃতি বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের স্মারক ভাস্কর্যগুলো সরানোর। এসব কর্মকাণ্ড কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকার এসব হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসলে প্রয়োজনে দেশের সব প্রগতিশীল মানুষ এবং সংস্কৃতি কর্মীদের সাথে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন বক্তারা।
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ বলেন, এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আবহমান বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংস্কৃতির উপর আঘাত হানার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। একটি চিহ্নিত মৌলবাদী, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বারবার এধরনের কর্মকাণ্ড করে এলেও এর বিরুদ্ধে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন মামুন।
তিনি বলেন, হেফাজতসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী মূলত শিল্পচর্চাকে বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরপর চারু শিল্পী সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী শিক্ষাক্রম থেকে চারুকলা বিষয়টিকে বাদ দেয়ার সমালোচনা করেন।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, শিবাণী ভট্টাচার্য্য, সহ-সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, ইকবালুল হক খান, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল প্রমূখ।