কালি মেখে-ধূয়ে পুরনো বছরকে বিদায় জানালো বান্দরবানের ত্রিপুরারা

কাল ত্রিপুরাব্দ নববর্ষ, আজ বৈসু উৎসবের আতাদাক

প্রকাশ | ১৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:৫৭ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৪৬

পপেন ত্রিপুরা

পাহাড়ের প্রতিটি ত্রিপুরা জনপদ এখন গরিয়র খেরবাই দলের নৃত্যে মুখরিত। চলছে তাল, নাচ ও লোক কাহিনী প্রদর্শনী। অঞ্চলভিত্তিক কিছু ভিন্নতাও দেখা যায়। যেমন- বান্দরবান পার্বত্য জেলার উসুই দফার ত্রিপুরারা খ্রিস্ট ধর্ম অনুসারী হওয়ায় এখানে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির মতো পাড়ায় গরিয়া নৃত্য পরিবেশন হয় না। তবে, অনেকটা শোভাযাত্রার মতো গরিয়া দেবের আহবানী শ্লোগান দিয়ে ফূর্তি করে থাকে।

১৪ এপ্রিল (শুক্রবার) ত্রিপুরাব্দ ১৪২৬ বর্ষের সর্বশেষ মাসের ৩১ তারিখ। ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবের দ্বিতীয় দিন আজ। সূর্যাস্তের সাথে সাথে বিদায়ের পালা শুরু হবে পুরনো বছর ১৪২৬ ত্রিপুরাব্দ। পরেরদিন (১৫ এপ্রিল) সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে নতুন বছর ১৪২৭ ত্রিপুরাব্দ শুরু হবে। কালো মানে অশুভ আর দুঃখ-গ্লানির প্রতীক। ত্রিপুরারা বৈসুর আগেই পুরনো সব কাপড়-চোপড় ধূয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলত। আর বান্দরবান পার্বত্য জেলার উসুই দফার ত্রিপুরারা গায়ে কালি মেখে-ধূয়ে পুরনো বছরকে বিদায় জানায়। এছাড়াও বান্দরবানের ত্রিপুরারা আরেকটি অভিনব খেলার আয়োজন করে থাকে বৈসুর দিনে।

শূকরের চর্বি মাখা তেলতেলে এবং প্রায় ৩০-৪০ ফুট একটি লম্বা বাঁশের আগায় টাকা, মদসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রি বেঁধে দেয়া হয়। তারপর পাড়ার ছেলেরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বাঁশের আগায় বেঁধে দেয়া উপহার সামগ্রিগুলো ছুঁতে চেষ্টা করে। একজনের কাঁধে ভর করে আরেকজন দাঁড়িয়ে যে দল উপহার সামগ্রি ছুঁতে পারে সেই দলকে উপহার সামগ্রী দেয়া হয়। শূকরের তেল মাখা বাঁশ বেয়ে উপহার সামগ্রী ছুঁতে অনেক কষ্ট সাধ্যের ব্যাপারও বটে।

ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসব শুরু হয়েছে ১৩ এপ্রিল। ফুল দিয়ে ঘর-বাড়ি সাজানো ও নানান করণের (রিচ্যুয়াল) মধ্য দিয়ে বৈসু উৎসব শুরু করে বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও বাংলাদেশের সিলেট, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, রাজবাড়ীসহ আরো বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ত্রিপুরাদের বসবাস। এক যুগে ত্রিপুরারা ত্রিপুরাব্দ বর্ষের বৈসু উদযাপন করে থাকে।

১৩ এপ্রিল, ২০১৭ তারিখে ১৪২৬ ত্রিপুরাব্দ ও ১৪২৩ বঙ্গাব্দ বর্ষের ৩০ চৈত্র। এ হিসেবে এ দিনে ত্রিপুরাদের হারি বৈসু। অর্থাৎ বৈসু উৎসবের প্রথম দিন। এ দিনে ত্রিপুরারা ফুল আর পাতায় ঘর-বাড়ি সাজায়। প্রতিটি ত্রিপুরাদের ঘরের দরজা এখন নিমফুল, বেতপাতাসহ নানান ফুলে সাজানো হয়েছে। গৃহপালিত প্রাণিকেও ফুলের মালা পরানো হয় এ দিনে। তিনদিনব্যাপী বৈসু উৎসবে পালন করা হয় নানান করণ (রিচ্যুয়াল)। এদিনের মধ্যে গাছের ফল, শাক-সবজি, তরি-তরকারি তুলে রাখতে হবে। কারণ দ্বিতীয় দিন বৈসুমাতে কোনো ধরণের কাটা মারা ছিঁড়া যায় না।

করণ (রিচ্যুয়াল)
ফুল দিয়ে গঙ্গা পুজা, হলুদ, ঘিলা ও কুচাই (তেঁতুলের মত শুকনো একটি জঙ্গলী ফল) একত্রে বেঁটে তা একটি বাঁশের চোঙায় ভরে, তারপর তিন বা সাত বাড়ির চালে পানি ঢেলে ছাউনি থেকে পড়ন্ত পানি চোঙা পেতে ভরতে হবে। এবং শেষে গঙ্গার (প্রবাহমান নদী) পানি মিশিয়ে শুদ্ধিকরণ পানি তৈরি করা হয়। এ পানি দিয়ে বাড়ির সকল সদস্যদেও ছিটিয়ে দেয়া হয়। তারপর ফলমূল গাছেও ছিটানো হয় এ পানি। এ করণটি করে থাকে ত্রিপুরা পুরুষরা। আর নারীরা করে ফুল দিয়ে গঙ্গা পূজা। বৈসু উৎসবে তিনদিন নদীর স্নানাঘাটের উজান ফুলেল হয়ে উঠে। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, এ পানি ছিটালে পুরনো বছরের গ্লানি, অশুভ শক্তি দূর হয়, বন্ধ্যা ফল গাছে ফল ধরবে। বৈসুতে নারী-পুরুষের এ করণগুলো তিনদিনব্যাপী হয়ে থাকে।

বৈসুমা বা আতাদাক
ত্রিপুরা বৈসুর দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা বা আতাদাক বলে থাকে। এ দিনেও প্রথম দিনের মতো করণ সম্পন্ন করা হয়। এদিন, ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা স্নান শেষে নতুন জামা কাপড় পরে বাটিতে করে ধান হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে। বাড়ির উঠানে ধান ছিটিয়ে ওই বাড়ির বয়স্কদের প্রণাম করে আরেক বাড়িতে চলে যায় ছেলেমেয়েরা। উঠানে ধান ছিটানোর উদ্দেশ্য হলো, গৃহপালিত হাঁস-মুরগির খাদ্য দান করা।

তারপর বেলা বাড়ার সাথে সাথে পানাহার করার পালা। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গন্দ(লাব্রা), পিঠা, পায়েস, সেমাই ইত্যাদি ভোজনে ব্যস্ত থাকে সব বয়সের মানুষ। তবে, বয়স্ক পুরুষরা মদ্য পানীয় বেশি গ্রহন করে থাকে বৈসুতে। এদিন কোনো মাছ-মাংস ভোজন করা চলে না। সম্পূর্ণ নিরামিষ। 

ভারত ও বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা চৈত্রের ৩০, ৩১ ও বৈশাখের ১ তারিখে হারি বৈসু, বৈসুমা ও বিসিকাতাল উদযাপন করে থাকে বলে অনেকেরই ধারণা ত্রিপুরারা বঙ্গাব্দ বর্ষকে ঘিরে উৎসব উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল বলে দাবি করেন, বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক মূখ্য প্রযোজক ও বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক প্রভাংশ ত্রিপুরা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বঙ্গাব্দ থেকে ত্রিপুরাব্দ তিন বছরের বড়। ত্রিপুরাব্দই আগে শুরু হয়েছিল। মূলত ত্রিপুরাব্দকে অনুসরণ করেই বঙ্গাব্দও পহেলা বৈশাখে নববর্ষ শুরু করেছিল।

বিসিকাতাল
পহেলা বৈশাখই ত্রিপুরাব্দের নববর্ষের শুরুর দিন। এদিন অন্যান্য রিচ্যুয়ালের সাথে বাড়ির মাতা-পিতা, দাদা-দাদীদের স্নান করানো হয়। নতুন কাপড় দান করা হয়। এদিন ত্রিপুরাদেও প্রতিটি বাড়িতে মাছ-মাংসের আয়োজন চলে। এদিন নারীরাও মদপানে অংশগ্রহণ করে থাকে।

গরিয়া
ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো তাঁদের প্রধান দেবতা গরিয়া দেবের পূজার নৃত্য। গরিয়া পূজায় যাঁরা নাচে তাঁদেরকে বলা হয় খেরাবই। গরিয়া দেবের প্রতিমূর্তিকে বহন করে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় নৃত্য পরিবেশন করে খেরবাই দল।

ত্রিপুরাব্দের সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য
জানা যায়, স্বাধীন ত্রিপুরা মহারাজা হামতরফা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরাব্দ বা ‘তিপ্রা বিসি কাতাল’ প্রচলন করেন। তখন খ্রিস্টাব্দের বাস্তবিক বয়স ছিল মাত্র ৯০ বছর। এবং ভারতে তার অস্তিত্বও ছিল না। শকাব্দের বয়স তখন ৫১২ বছর এবং ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত অব্দ ছিল। শকাব্দের পরবর্তী বিভিন্ন অব্দের ন্যায় ত্রিপুরাব্দও শকাব্দের মাসকেই অনুসরণ করতো। ত্রিপুরাব্দের মাসের সাথে শকাব্দের মাসের যে সামঞ্জস্য ছিল তার প্রমাণ ত্রিপুরা রাজাদের সনন্দ বা তাঁর শাসনে পাওয়া যায়।

২০০৮ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে প্রকাশিত ‘ট্রুথ এ্যাবাউট ত্রিং’ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ চটি বইয়ে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, বঙ্গাব্দ প্রচলনের তিন বছর আগে ত্রিপুরাব্দ প্রচলন হয়েছিল। অর্থাৎ ত্রিপুরাব্দকে অনুসরণ করেই বঙ্গাব্দ প্রচলন করা হয়েছিল। 

ত্রিপুরাব্দ বর্ষের মাস ও বারের নাম কেন বাংলায় রাখা হলো? এ ব্যাপারে, লেখক ও গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা বলেন, ‘স্বাধীন ত্রিপুরা মহারাজারা বাংলা সাহিত্যেও অনুরাগী ছিলেন এবং সেসময় ককবরক (ত্রিপুরা ভাষা) লিখিত রূপের চর্চা ছিল না, এ কারণে শকাব্দের বার ও মাসকেই অনুসরণ করা হয়েছিল।’

বর্তমানে ত্রিপুরাদের কিছু সংগঠন ত্রিপুরাব্দ ক্যালেন্ডার নামে মাঝেমাঝে যে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে থাকে এটা সর্বজন স্বীকৃত নয় বলেও অভিমত প্রকাশ করেন প্রভাংশু ত্রিপুরা। তাঁর দাবি, এটা ত্রিপুরা রাজ্যের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রচলন করা ক্যালেন্ডার। এই বিতর্কিত ক্যালেন্ডারটি খ্রিস্ট ধর্মের কিছু উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছিল বলেও তাঁর দাবি।

ভারতের গবেষক ড. অতুল দেববর্মার প্রস্তাবিত ককবরকে বার, মাস, ঋতুর নাম ব্যবহার করে ত্রিপুরাব্দ বর্ষ পঞ্জিকা প্রচলন করতে বাংলাদেশে বসবাসরত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের প্রতি আহবান জানান।

সূত্র: এনটিভি