এসো পা বাড়াই (১৪ তম পর্ব)

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:০৪ | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:২২

"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"

LEAN IN                                                                 এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD         নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG                           অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি

এই কয়দিন আগেই আমাকে মনে করিয়ে দেয়া হলো যে এই নমুনা অব্যাহত থাকে, এমনকি আমরা বড় হয়ে গেলেও। খুব বেশি আগের কথা না, একটা ছোট্ট রাতের খাবারের আয়োজন ছিল অন্যান্য ব্যবসায়ী কার্যনির্বাহিকদের সাথে, যেখানে সম্মানিত অতিথি এক নিঃশ্বাসে পুরো সময় জুড়ে তার বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যার মানে কোন প্রশ্ন করা বা মতামত দেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, তার কথার মাঝে ব্যাঘাত করা। তিন চার জন পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের প্রশ্ন করলো এবং অতিথি সবিনয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন আবার তার বক্তৃতা চালু করার আগে। এক পর্যায়ে, আমি আলোচনায় কিছু যোগ করার চেষ্টা করলে তিনি গর্জে উঠলেন, “আমাকে শেষ করতে দাও, তোমরা একদমই কথা শুনতে জানো না!” পর্যায়ক্রমে আরও কিছু পুরুষ তার কথার মাঝে কথা বললেন এবং তিনি তা অনুমোদন করলেন। তারপর অন্য যে একমাত্র নারী কার্যনির্বাহী ছিলেন সে কথা বলতে নিতেই, তিনি আবারও একই ব্যবহার করলেন, আমার সাথে যেরকম করেছিলেন! বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য অতিথি সাহেব তাকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করলেন। 

খাবারের পর এদের মধ্যের একজন পুরুষ সিইও আমাকে একপাশে নিয়ে বলল যে, তিনি খেয়াল করেছেন যে শুধু নারীদেরকেই চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আমাকে আরও বলেছিলেন, তিনি সহানুভূতি অনুভব করছেন, কারণ একজন হিস্পানিক হিসেবে তিনি নিজেও অনেকবার এরকম ব্যবহারের স্বীকার হয়েছেন।

(স্প্যানিশ ভাষাভাষী যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরাই মূলত প্রচলিতভাবে হিস্পানিক নামে পরিচিত। অভিন্ন ভাষা ছাড়াও তাদের আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিতে রয়েছে স্বকীয়তা।)

কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিদের এই নারীকণ্ঠ চুপ করিয়ে দেয়া, তাৎক্ষণিক সমস্যা ছাড়িয়েও বহু বিপদের ঝুঁকি বাড়ায়। তরুণ নারীরা 'উপযুক্ত' আচরণ এর সংজ্ঞা হিসেবে এই সামাজিক ইঙ্গিতকে ভেতরে ধারণ করে এবং পালাক্রমে তারা নিজেরাই নীরব হয়ে যায়। মায়ের মত সুন্দরী হওয়ার জন্য তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয় এবং মায়ের মতই প্রতিপালনে তাদেরকে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া অ্যালবাম, ফ্রি টু বি---ইউ এন্ড মি (Free to be---you and me) আমার শৈশবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল। আমার প্রিয় গান ছিল, 'উইলিয়ামের পুতুল' (William's Doll), যা একটা পাঁচ বছর বয়সের বালককে নিয়ে। বালকটি তার অনিচ্ছুক পিতার কাছে অনুনয় করছিল তাকে একটি প্রচলিত মেয়েদের খেলনা কিনে দিতে। 

প্রায় ৪০ বছর পরেও, খেলনা শিল্প বাঁধাধরা ছকেই জর্জরিত। ২০১১ সালের ঠিক ক্রিসমাসের আগে আগে রাইলি (Riley) নামের একটি চার বছরের মেয়ের ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। রাইলি, একটি খেলনার দোকানের মধ্যে বিপর্যস্তভাবে হাঁটছে কারণ কোম্পানিগুলো চেষ্টা করছে, “মেয়েদেরকে ধোঁকা দিতে, ছেলেরা যা কিনতে চায় তার বদলে মেয়েরা যেন সব গোলাপী পণ্য কিনে, ঠিক না?” ঠিক তাই। 

রাইলির মতই, “বেশকিছু মেয়ে সুপারহিরোদের পছন্দ করে, কিছু মেয়ে রাজকুমারীদের, আবার কিছু ছেলে সুপারহিরোদের পছন্দ করে, কিছু ছেলে রাজকুমারীদের। তাই কেন সব মেয়েদের গোলাপী পণ্য কিনতে হবে এবং সব ছেলেদের অন্য রঙের পণ্য কিনতে হবে?” একটি চার বছরের শিশুকেও সামাজিক প্রত্যাশা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রায় বিদ্রোহের কাছাকাছি আচরণ করতে হয়। উইলিয়ামের এখনো কোন পুতুল নেই, যখন রাইলি একটি গোলাপী সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে। আমি এখন আমার সন্তানদের জন্য 'ফ্রি টু বি---ইউ এন্ড মি' বাজিয়ে শোনাই এবং আশা করি ওরা যদি কখনও ওদের সন্তানদের জন্য এটা বাজায়, তাহলে বার্তাটা মনে হবে অতি প্রাচীন।

(চলবে...)