পুরুষেরা এখনও নারীদের প্রভু: তসলিমা
প্রকাশ | ০৯ জুন ২০১৬, ০২:৩১
ভারতীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের মুখোমুখি হয়েছিল। টাইমস অব ইন্ডিয়ার নেয়া তসলিমা নাসরিনের সাক্ষাতকারটি জাগরণীয়া’র পাঠকদের জন্য পুনরায় প্রকাশিত করা হলো।
প্রশ্ন: আপনি আমেরিকায় কি মনে করে?
তসলিমা: বেশ, এখানে বক্তব্য রাখতে এসেছিলাম। তাছাড়া পরিবারের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারও ছিল।
আজকাল আরও একটা বিষয় নিয়ে বেশ বিরক্ত আমি। বাংলাদেশি এক পত্রিকায় পুলিশের তৈরি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, যে সংগঠনটা ওখানে ব্লগারদের হত্যা করছে, ওরাই নাকি ভারতে এসে আমাকেও হত্যার পরিকল্পনা আঁটছে। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। সবাই বললো ভারত থেকে কিছুদিন দূরে থাকাই হয়ত সমীচীন হবে।
কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্বের গণমাধ্যম সব বলতে শুরু করেছে, আমি নাকি চলে এসেছি আমেরিকায়। পাগল নাকি! ভারতের স্থান আমার হৃদয়ে। আর আমার সমস্ত বই, জিনিসপত্র, আমার পোষা বেড়ালটা সবই তো ভারতে পড়ে আছে!
যাহোক, এইসব নিরাপত্তাজনিত ব্যাপারগুলো নিতান্ত গৌণ। এখানকার এক মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে কাজ করার জন্যেই মূলত আসা হলো। ওরা বাংলাদেশের হত্যার হুমকি পাওয়া ব্লগারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে অর্থ সংগ্রহে নেমেছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ব্লগারদের কেন হত্যা করা হচ্ছে?
তসলিমা: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। একইভাবে ইয়েমেনি আল-কায়েদার সংগঠক আনোয়ার আল আওলাকির কাছ থেকে প্রভাবিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীরা, নৃশংসভাবে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে হত্যা করছে নিধার্মিক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের।
দুই কালের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য মূলত একই। ওরা চাইছে এদেশে ধর্মান্ধ আর নারীবিদ্বেষী ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না। এরইমধ্যে রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়সহ আরও অনেক মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী ব্লগারকে তারা ইসলামের সমালোচনা করার জন্যে হত্যা করেছে।
সরকার হত্যাকারীদের ওপর কঠোর না হয়ে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিচার করতে গিয়ে ইসলামবিরোধী আখ্যা পেয়ে যায় কিনা এটাই সরকারের ভয়ের কারণ। তেমন ঘটলে তো ভোটের রাজনীতিতে ব্যাপক ধস নামতে পারে। তোষণের রাজনীতি আরকি!
প্রশ্ন: আপনি কি ভারত সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছেন?
তসলিমা: আমি ভেবেছিলাম ওনাদের কারও সঙ্গে বুঝি দেখা করতে পারবো। কিন্তু ওটা পারলে কি আর আমাকে ভারত ছেড়ে আসতে হতো!
আমার ব্লগার বন্ধুর রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে কেমন লেগেছে আমার? একটা কোনো দরদী হাতের অভাব তখনকার মতো এতো প্রবলভাবে আর অনুভব করিনি।
ভারতে থাকার ইচ্ছে ফুরোয়নি আমার। ইউরোপে নির্বাসন ছেড়ে আমি কলকাতায় এসেছিলাম। যদিও কলকাতা আমার খুবই ভালো লেগেছে, তবুও বলতেই হচ্ছে, ওখানকার রাজনীতিকরা তাদের স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছে।
আমাকে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। এরপর তো একটা সাজানো গণ্ডগোল বাঁধিয়ে, আমাকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হলো। দিল্লিতে গৃহবন্দি হয়ে থাকলাম। একসময় বাধ্যও হলাম ভারত ছাড়তে।
যাক, এতোকিছুর পরও কিন্তু হাল ছাড়িনি আমি, ভারতে আসা-যাওয়াটা বজায় রেখেছিলাম। একসময় সরকার সদয় হয়ে এখানে থাকতে শুরু করার অনুমতি দিলেন।
এই উপমহাদেশে দিল্লিই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারি। আমার গৃহপ্রতীম উপমহাদেশেই থাকতে পারছি আমি, এটাও খুব আনন্দের।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কি নারীরা স্বাধীন?
তসলিমা: নারীর স্বাধীনতা ওখানে বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার। নারীদের বোরকা পরতে, হিজাব জড়াতে বাধ্য করা হয়। তাদেরকে আধামানুষ হিসেবে গণ্য করা করা। পুরুষেরা এখনও তাদের প্রভু।
প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনি আম আওরাত পার্টির কথা বলছেন। এ বিষয়ে যদি বিস্তারিত বলতেন।
তসলিমা: বেশ। এখানে মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী এবং ওরা শোচনীয়ভাবে বঞ্ছিত। তাদের প্রয়োজন, যাপিত সমস্যাগুলোর সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমাধান।
বর্তমান বিশ্বে নারী-পুরুষ সমতার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সুইডেন। ওখানেও নারীবাদি রাজনৈতিক দল আছে। তাহলে ভারতে নয় কেন?
ভারতে একটি নারীবাদি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন সুইডেনের চেয়েও অনেক গুণ বেশি।