এসো পা বাড়াই (২য় পর্ব)
প্রকাশ | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ২২:১৬ | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৬, ২২:২৯
"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"
LEAN IN এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি
আজকের ইউনাইটেড স্টেইটস এবং উন্নত বিশ্বে নারীরা আগের থেকে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। যারা আমাদের আগে এসেছিল, আমাদের আজকের স্বীকৃত যে অধিকার তা আদায়ের জন্য যারা লড়াইয়ে নেমেছিল, আমরা তাদের কাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আছি। ১৯৪৭ সালে আমার দীর্ঘদিনের মেন্টর ল্যারি সামার্স (Larry Summers) এর মা অনিতা সামার্স (Anita Summers) একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানীতে, তার চাকুরীতে যোগদানের সময় তার নতুন বস তাকে বলেছিল, “আমি ভীষণ খুশি যে অপেক্ষাকৃত কম বেতনে আমি একই বুদ্ধিমত্তা পাচ্ছি”। সে একজন পুরুষের সমান ব্রেইন এর অধিকারী, এটাই ছিল তার জন্য বিশাল একটা প্রশংসা। যদিও সমান বেতন ভাতা চাওয়াটা ছিল তার জন্য অচিন্ত্যনীয়।
আমরা আরো বেশি কৃতজ্ঞতা অনুভব করি যখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীদের সাথে আমাদের জীবনের তুলনা করি। এখনো এমন অনেক দেশ আছে যেখানে নারীদের মৌলিক নাগরিক অধিকার-ই নেই। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪.৪ মিলিয়ন নারী এবং মেয়েরা দেহ ব্যবসার ফাঁদে পড়ে আছে। আফগানিস্তান এবং সুদানের মত অনেক স্থানেই মেয়েরা খুবই অল্প অথবা কোন লেখাপড়ার সুযোগই পায় না, স্ত্রীরা স্বামীর সম্পত্তি বলে বিবেচিত হয় এবং ধর্ষিত নারীদের সবসময় নিজের পরিবার থেকেই বাঁকা চোখে দেখা হয়, পরিবারের সম্মানহানীর অপরাধে। এমনকি কিছু রেপ ভিকটিমকে জেলেও পাঠানো হয় অনৈতিক অপরাধ করার কারণে। নারীদের প্রতি অগ্রহণযোগ্য আচরণ বিবেচনায় এই সব দেশ থেকে আমরা শতবর্ষ এগিয়ে আছি।
হয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে কিন্তু তা জেনে এ অবস্থার উন্নতির চেষ্টা না করাটা আমাদের উচিত হবে না। ব্রিটেনে বিশ শতকের গোড়ার দিকে নারীর ভোটাধিকারের লড়াইয়ে যারা রাস্তায় নেমেছিল তারা নারী পুরুষের সত্যিকারের সম অধিকারের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিল। এক শতাব্দী পরেও সেই স্বপ্নকে আমরা তীব্রভাবে খুঁজছি, এদিকেই সবার দৃষ্টি আনতে চেষ্টা করছি।
স্পষ্ট সত্য এটাই যে, পুরুষরাই এখনো পৃথিবী চালাচ্ছে। ১৯৫টি স্বাধীন দেশের মধ্যে মাত্র ১৭ টির নেতৃত্ব দিচ্ছে নারীরা। সারা পৃথিবীতে সংসদীয় আসন দখল করে আছে মাত্র ২০% নারী। নিরপেক্ষ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী যে ইউনাইটেড স্টেইটস নিয়ে আমরা গর্বিত সেখানেও নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সহাবস্থান মোটেও ভালো নয়। ১৯৮০ সালের শুরুতেই ইউনাইটেড স্টেইটসে কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে নারীর অনুপাত ৫০% হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই ধীরে, দৃপ্ত পায়ে নারীরা অগ্রসর হচ্ছে, দিন দিন কলেজ ডিগ্রী নেয়া নারীর সংখ্যা বাড়ছে, চাকুরীর প্রাথমিক স্তরে প্রচুর নারীরা আসছে এবং আরও অনেক কর্মক্ষেত্র যেখানে আগে পুরুষ আধিপত্য ছিল সেখানেও নারীরা আসছে। এত প্রাপ্তি সত্ত্বেও, বিগত দশকে কর্পোরেট আমেরিকার সর্বোচ্চ আসনগুলোতে নারী সংখ্যার শতকরা হারে তেমন কোন পরিবর্তন আনা যায়নি। ভাগ্যবান ৫০০ CEO (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার) এর মধ্যে নগণ্য ২১ জন মাত্র নারী। শতকরা হিসেবে প্রায় ১৪% দখল করে আছে এক্সিকিউটিভ অফিসার পদ, ১৭% বোর্ড সীট এবং ১৮% নারী নিয়োগ পায় আমাদের নির্বাচিত কংগ্রেশনাল আমলা হিসেবে। বর্ণ বৈষম্যের শিকার নারীদের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান আরো খারাপ, তারা সর্বোচ্চ পদগুলোতে কর্পোরেট জবের মাত্র ৪% দখল করে আছে, মাত্র ৩% বোর্ড সীট এবং ৫% আছে কংগ্রেশনাল আসনে। যেখানে নারীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত পুরুষদের সরিয়ে দিয়ে তাদের অর্জন অব্যাহত রাখছে সেই সময়ে যে কোন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে যেতে আমাদের সত্যিকার অগ্রগতি নেই। যার ফলে পৃথিবী পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে নারীরা সমানভাবে প্রভাব ফেলতে পারে না।
একইরকমভাবে বেতন ভাতার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি মন্থর। ১৯৭০ সালে একই ধরনের কাজে, পুরুষের প্রতি ডলার আয় এর সাথে তুলনায় নারীরা পেত ৫৯ সেন্ট করে। ২০১০ সাল নাগাদ নারীদের তীব্র প্রতিবাদ, আন্দোলন আর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ সেন্ট যখন একজন পুরুষ পায় ১ ডলার। ২০১১ সালের, 'Equal Pay Day' তে এক্টিভিস্ট মার্লো থমাস (Marlo Thomas) তাই বিদ্রুপ করে বলেছিল, "৪০ বছরে ১৮ সেন্ট, যখন একডজন ডিমের দামও বেড়েছে এর দশ গুণ”।
(চলবে...)