লিঙ্গ বৈষম্য: লোক সাহিত্যে

প্রকাশ : ২৫ মে ২০১৬, ১৫:০৫

মিহির চৌধুরী কামিল্যা

 

সেদিন আমারই বিয়ে। বাসর ঘরে ঢুকেছি। অমনি নাপিত দাদু চিৎকার করে বললেন- ‘দাঁড়াও নাতজামাই।’ বলেই গান ধরলেন- ‘হলুদ বনে ওকে ঘুরিছো, ওগো মনোমোহিনী।/ দেখতে দেখতে কাছে এলাম, তুমি কি সব বোঝোনি’/ সারা মাঠে কেউ কোথা নেই, সূর্য্যু ঢলে আকাশে।/ উড়ে এসে বসত করি তোমার ফাগুন বাতাসে।।/ ওগো মনোমোহিনী/ তুমি কি সব বোঝোনি।/ মুখ দেখালি চোখ দেখালি তবু ছুঁতে লারি হে।/ তুমি মেয়ে, আমি মরদ, এই ফরমান জারি হে।।’, আমরা হেসে উঠলাম। কিন্তু এটা তো বুঝলাম স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কটা বড়ো রহস্যময়। শুধু প্রেম ভালবাসাই নয় তাদের ঝগড়া বিবাদ, লাভ ক্ষতি জটিল রহস্যে ঢাকা। তাই সবকালে সব সাহিত্যিক সেই রহস্যে মুগ্ধ হয়েছেন। কেউ অভিভূত হয়েছেন। কেউ স্তব করেছেন। আবার কারও ক্ষুধার বুদ্ধি মুহূর্তে বেলুনের মত চুপসেও গেছে।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে তাই সব দেশে নানা ধারায় সাহিত্য রচিত হয়েছে। সমালোচকেরাও সেই জটিল রহস্যের কুয়াশাচ্ছন্ন দিকগুলি উদঘাটনে ব্রতী হয়েছেন। এ নিয়ে মানবীবাদ, মানবী চেতনা, নারীতত্ত্ব, নারী জিজ্ঞাসা কম গড়ে ওঠে নি। সম্প্রতি যৌনবিজ্ঞান, স্ত্রী লিঙ্গ নির্মাণ ইত্যাকার নামে নারী ও পুরুষ বিচিত্র ভাবনা তাঁরা প্রকাশ করে চলেছেন। দিন যতই এগোচ্ছে, নারী সম্পর্কে মানুষের ধারণা ততই বিবর্তিত হচ্ছে এবং নারী বিষয়ক ভাবনার নব মূল্যায়ন ঘটছে। নারীর সমাজজীবন, বিবাহিত জীবন, কর্মক্ষেত্রে প্রভৃতি জীবনযাপনের প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত দিকগুলির চুলচেরা বিশ্লেষণে অনেকেই উদগ্রীব হয়েছেন। অতি সম্প্রতি এদেশেও নারী-পুরুষের গঠনগত প্রকৃতি, জীবনগত ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে ভাবুক সমাজ গলদঘর্ম হয়েছেন। অ্যারিস্টটল, রুশো, ইকসিলাস, টমাস অ্যাকুনাস, মেরি উলসস্টোন ক্রাফট (১৮শ), জন স্টুয়ার্থ মিথ (১৯শ), মেরি মার্গারেট ফুলার (১৯শ), ভার্জিনিয়া উলফ (২০শ) থেকে কার্ল মার্কস পর্যন্ত অনেকেই বিচিত্র ভাবনা উপস্থাপন করেছেন। এদেশেও মুন থেকে মল্লিকা পর্যন্ত এ ভাবনার শরিক। বাইবেলেরও দু’আড়াই হাজার বছর আগে সৃষ্টি ‘ই-নানা-ন’ মহাকাব্যে একজন দেবী, দেবতার দ্বারা অপদস্ত হচ্ছেন এমন তথ্যও মেলে।

এ কথা অনেকটাই ঠিক যে, পুরো পৃথিবীটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে চলেছে। সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে নারী সর্বতোভাবে বেরিয়ে আসতে পারে নি। প্রকৃতি প্রদত্ত লিঙ্গ নির্মাণ একসময় বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। শ্রম বৈষম্য ঘটেছে, লিঙ্গ বৈষম্য তো ঘটেছেই। যুগে যুগে কালে কালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে একটি পৃথক স্থানে বসিয়ে দিয়েছে। শিশুকন্যা, বধূ, মাতা বা শাশুড়ি, ঠাকুমা বা দিদিমা- তাকে যে রূপে দেখি না কেন, সে কিন্তু এখানকার ভাষায় স্বকীয় হতে পারে নি। সংসারের সব স্তরেই তাকে প্রচণ্ড শ্রম দিতে হয়। প্রাত্যহিক ঘরদোর পরিস্কার বাসন কোশন পরিমার্জন, সন্তান সন্ততির দেখভাল, শ্বশুর শাশুড়ি ও অন্যান্যদের পরিচর্যা, অতিথি আপ্যায়ন, সর্বোপরি স্বামী, শ্বশুর ও গুরুজনদের মনতুষ্টি সাধন করাটাই তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর সাম্প্রতিককালে নারীর জীবনে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত ইত্যাদি হাজার রকম জিনিস এসে যুক্ত হয়েছে। তবে আমাদের সমাজে নারীকে স্ত্রী ও মাতৃকারূপে সবিশেষ ভূমিকা পালন করতেই দেখা যায়। কিন্তু এতে করেও নারী সমাজ ও পরিবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর সেই বঞ্চনা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। পুরুষশাসিত সমাজ নারীর শরীর ও শ্রম দুটোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে।

অন্যান্য সাহিত্যের মতো, এই নারী-পুরুষের জীবনযাপনের এই প্রভেদ, বাংলা লোকসাহিত্যও নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে। এ অসহনীয় দুঃখ ও বৈষম্যকরেই একদা প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। ‘-যাবৎ সীতা তাবৎ দুখ/ সীতা মরলে যাবেক দুখ।’ -এখানে সীতা মানে দুঃখিনী অত্যাচারিত নারী। শুধু প্রবাদেই নয়, বাংলার লোকসাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় এই বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। বাংলার বাদুগান, টুসুগান,আহিয়া গান, দরমুজ গান, সাখি গান, কাঠি নাচের গান, করমে যাওয়ার ঈদের গান, ঝুমুর গান, জাগ গান প্রবৃতি অসংখ্য গানে এই লিঙ্গ বৈষম্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। ছাড়ায় তো আছেই। এছাড়া বাধা প্রবাদ, প্রবচন, রুপকথাতেও আছে।

বাংলায় ছড়া আছে অসংখ্য। তার মধ্যে ঘুমপাড়ানি ছড়া ও ছেলে ভুলানো ছড়া খুব উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই সব ছড়ায় শিশুপুএকে নিয়ে যেভাবে গান বাধা হয়েছে, শিশুকন্যাকে নিয়ে তত সংখ্যক গান নেই। এমকি শিশুপুএকে নিয়ে আমাদের মা মাসির যে আনন্দ উল্লাস কিংবা উৎকন্ঠা, আশঙ্কা ও আতঙ্ক প্রকাশ করে গেছে, শিশুকন্যাকে নিয়ে ততটার সাক্ষী মেলে না। তবে এমন কিছু গান আছে যেগুলিকে শিশুপুএের স্থানে শিশুকন্যাকে বসানো যায়। কিছু গান আছে যেগুলি শিশুপুএের স্থানে শিশুকন্যাকে বসানো যায়।

১)
আয় রে আয় টিয়ে
নায়ে ভর দিয়ে
না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে
তাই না দেখে ভোঁদর নাচে
ওরে ভোঁদর ফিরে চা
খোকন নাচন দেখে যা।।

২)
ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।

৩)
আয় রে পাখি বসবে ডালে। ভাত দিবরে সোনার থালে
খাবিদাবি কলকলাবি। খোকাকে নিয়ে ঘুম পাড়াবি।

৪)
অন্যরকম ভাবনা-
আয় রে আয় বনচড়ায়া বনের ভিতর দিয়া
খোকার মা পান খেয়েছে শাউড়ি বাধা দিয়া।

৫)
ধন গেছেরে কোনখানে, বাসফুলে বনপানে
সেখানে ধন কি করে, ডাল ভেঙ্গে ভেঙ্গে ফুল পাড়ে

৬)
ও পারেতে কুলগাছটি নই ছাগলে খান।
তার তলা দিয়ে খোকা বিয়ে করতে যায়।
বিয়ে করতে গিয়ে খোক কি পায় যৌতুক।
হাতে পায় হীরার বালা বালা,মাথায় মুকুট।।

৭)
ধন ধন ধন
এ ধর যার ঘরে নাই তার কিসের জীবন

৮)
ধন ধন ধন/হরুদ বাডির বন
এ ধন যে দেখতে লারে, পুডুক তার মন
এ ধন যার ঘরে নাই, তারা কিসের গরব করে
তারা পুডে কেন নাই মরে।

অপরপক্ষে শিশুকন্যাদের নিয়ে এমন ভাবনার কোনো কোনো গানে তার দেহ পরিপাটির কথা আছে।কোথাও কোথাও আছে শ্বশুর বাড়ির যাওয়ার কথা, কোথাও আছে ছিচকাদুনের মেয়ের মজাদার কাহিনী। সেখানে অবজ্ঞা অবহেলার চুড়ান্ত অবয়ব।

১) মেয়েছেলে কাদার ডেলা। ধপাস্ করে জলে ফেলা।
২) খুকু কেন রে কাঁদে। ভিজে কাঠে ভাত রাঁখে।
৩) খুকুর বালা/টাকার ছালা/মটকি ভরা ঘি।
৪) তালগাছ কাটন/বেসন বাটন/গৌরি হেনঝি।
তোর কপালে/ বুডো বর তা/ আমি করব কি।।

অথচ শিশুর বেলা-
১) খোকা উঠেছে নায়ে/লাল জুতুয় পায়ে।

২) সোনার অঙ্গুরি বাকাও ভাল।এখানে 'সোনার অঙ্গুরি' মানে খোকা।

অর্থাৎ ছড়াতে কোথাও শিশুকন্যাকে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এখানেও সেই বেদের কথা- কৃপণং দুহিত পুএো হ জ্যোতিঃ পরম কেমন কৃপার পাএ। পুএ পরমস্বর্গে আকাশদীপ। রবীন্দভাষ্যেঃ ভাইটি অমূল্য/ননই তার তুল্য/সংসার বোনটি/নেহাৎ অতিরিক্ত। প্রচলিত ধারণার কন্যা পরের সম্পতি। বিয়ের পর চলে যাবে অন্যের বাড়িতে। কিন্ত বাড়িতে থাকবে শিশুপুএ। সেই হচ্ছে বংশরক্ষার নিদান। সেই হচ্ছে কর্তার উত্তারাধিকারি। সে রোজগার করবে বৃদ্ধ পিতামাতা কে খাওয়াবে। রোগে অসুখে দেখবে। কিন্ত কন্যা তো তখন থাকবে তার স্বামীরগৃহে। সে বড় পরাধীন। হঠাৎই বাপের বাড়ি আসার সার্মথটুকুও থাকে না। তাই পিতামাতা আত্নীয়পরিজন তাকে নিয়ে উল্লাস করেনি। গানের বন্যা বহায়নি। আর এখানে স্পষ্ট হয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য লক্ষণীয় অনাদর উপেক্ষা।

লোকসাহিত্যের অন্যান নানা শাখায় লিঙ্গ বৈষম্যের কিছু কিছু উদাহরণ মেলে। পাতাগানে একজন নারীর খুব দুঃখ হয়। সে জন্ম থেকে বড়ো পরাধীন। পিতৃগৃহে থাকে অনাধরে লালন করা হয়। তা পিাশাক আশাকে, কথাবার্তায় রঙ্গতামাসায় সে একজন পুরুষের সমান গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নয়, একথা সে বুঝেও বোঝে না শ্বশুরবাড়িতে সে যে পরের মেয়ে, সে যে শ্বশুর কন্যার থেকে অনাদার পাবে এই বোধটিও তার জেগে ওঠে। তাই নারীর নিশ্চিন্তে সু-আদরে দাঁড়াবার ঠাই থাকে না।
সে বলে-
মেয়্যার জনম ঝিঙ্গা ফুলের কলি হে
সাঁঝে ফুটে সকালে ঝরি যায়।
কেউ দেখে, কেউ দেখে না হে
অকালে দহলাঁই মরি যায়।
বাপ বলে, বিটি ছানা, পরের ঘরে কদিন পরে
শ্বশুর বলে,পরের বিটি, তার আবার ট্যামক হকে কেনে।
আমি কুথায় দাড়াবো ভগবান।
খ্যাটে খ্যাটে মরি গেলি হে, শুকাঁই গেলি হে দিনমান।
এতো গেল পিতৃকুল মাতৃকুল অবজ্ঞা ইতিহাস।
দমন, পীড়ন অত্যাচার-দুই পক্ষে অনেকটা সমান।

কন্যার লেখাপড়া নিয়েও অভিভাবক ভাবিতে নয়। সেকালে এই ধারণাই বলবৎ ছিল যে, শিশুকন্যার বিদ্যাচর্চার প্রয়োজন নেই। যা শেখাতে হবে তা পুএকেই। সমাজ বুঝিয়েছিল পুএের তুলনায় কন্যার বুদ্ধি কম। তার ওপর লেখাপড়া শিখলে সংসারে যে সাহায্য করতে পারে না।তার ওপর ছোটো বয়সেই বিয়ে হয়ে যাবে। তাকে বরং ভালো করে সংসারের কাজ শেখানো উচিত। তাই শিশুকন্যার সামনেই তার ভাই দাদা পাঠশালায় যায়। তাকে নিয়ে পিতামাতা নানা ভবিষ্যৎ ভাবনা প্রকাশ করে। তার খাওয়া দাওয়া পোশাকের দিকে নজর দেয়। এই হতভাগী বোনটিই কখনও পাঠশালায় পোঁছে দেয়। বাকি সময় ঘরের কাজে মগ্ন হয়। মায়ের এটা ওটা করে দেয়। বাকি সময় ঘরের কাজে মগ্ন হয়। খুব দরিদ্র জলে বাগালিতেও যায়। ঝুমুর গানে সেই পরিচয় আছে-

বলি, ও বাপ, তুমি কেমন আমার বাপ হে।
চোখে থাকতে করলি কানা, বাপ না দুমি সাপ হে।।
বলি) সাপও কানা, বাপও কানা, কানা আমার মা।
বলি) ও সাপেরা বিটি ছানার জোড়া চোখ কুরে কুরে খা।।
ভাই গেছে পাঠশালে কুঙ্গি পুথি নিয়ে।
আমি যাচ্ছি বাগালিতে ঘরে আগুড় দিয়ে।
ভাইয়ের হাতে দুধের গেলাস আমার জলের বাটি।
ভাইয়ের হাতে টানা মোয়া আমি আথাল চটি।।

উৎসব পার্বণে শিশুপুএদেরই গুরত্ব দেওয়া হয়। তাকে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয়। মেলাতে গিয়ে ভালমন্দ খাওয়ানো হয়। তার ইচ্ছামতো নাগরদোলায় চড়ানো হয়। মেয়ে চাইলে বাপ-মা ঝাঝিয়ে ওঠে। বলে মাথা ঘুরে যাবে সরে যাবি। চল তোকে ভলো জিনিস দেখাব। ছেলেকে বলে নে খোক উঠ। বেচারা কন্যারত্নটি নীরবে তা সহ্য করে। তার ছলছল চোখ কেউ দেখেও না বাদরনাচের গানে তার পরিচয় আছেঃ বাঁদরী সুন্দরী নাচিয়ে বলছে-

ভাইটি তোমার সোনার জাদু, বোনটি গোবরে ঢেলা।
ভাই নিবি না বোনকে লিবি এখন সাঁজের বেলা।।
ভাই যাকে কিয়ের কেশে আপদ বিপদ মেয়ে।
বোন লিব না বোন লিব সা বোন মরেছে ভয়ে।।

এক সময় কন্যা সন্তানের বিয়ে হয়। সে শ্বশুর ঘর করে। দাসী-চাকরানির মতোই অহোরাএ খাটে। কোসো কাজ করতে না পারলে গালমন্দ খায়। সঙ্গে মার ও বাদ যায় না। বাপ মায়ের নিন্দার কান ভরে যায়। তাই বাপের বাড়ির গ্রামে যখন পালাপার্বন হয় তখন বধুর পিতৃগৃহে যাওয়ার বড়ো সাধ হয়। কিন্ত নিজেদের খাটতে হবে ভেবে শাশুড়ি কিংবা তাকে যেতে দেয় না। তাই এক এক বধূর মন যন্ত্রনায় ছটফট করে। বাড়ির মেয়েরা সেই গ্রামে পর্ব দেখতে গেলেও শাশুড়ি তাকে যেতে অনুমতি দেয় না। আহিরা গানে সেই বিন্দদাশার কথা-

কনটিনে আমার বাবা দাদা, কনটিনে মা থাকো গো
আমাগো য্যাত্যে দেয় না বাঁদনা পরবে, এত দয় মাগো গো
শাউরি বলে পাঠাবো না, সোয়ামি লাঠি হাতে গো
এলাকা যাবি, লাজ বাসানা, তোর বাপরে কি রাতে গো।।
লোক চলছে হদা হদা, বাজনা বাজে লহরে।
সোয়ামী আমায় শাঁসাই গেল গরু নিয়ে ডহরে।
কোপিলা গাই হামলায় মা, তারো চোখে জল গো।
কেমনে যাইবো মাগো, পড়শি জল খল গো।।

কখনও কখনও স্বামী স্ত্রীকে বাপের বাড়ি যেতে দেয় না। ইঁদ করম ‘জাওয়া’ উৎসবে স্বামীর এই ব্যবহারে বধু ক্ষোভে ও ক্রোধে দিশেহারা হয়ে উঠে। ইঁদ জাওয়া গীতে তেমনি একটি গান আছে-

বড় জাকেঁর ইঁদ পরবে ভাই আইলি লিতে গো।
খালভরা নাচি দিল জাতে
ভাই আমার কাঁদে কঁকাই কেমন পারা হলো গো।
খালভরাটা দিল বেদম বকে।
কত কষ্টে চুলা জ্বাললাম, পাঁচ ব্যঞ্জন খাওয়ালি গো
উচিৎ কথা বলতে গেলম
খালভরা জুমড়া কাঠে ধাসে দিল মুখে

কখনও কখনও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাঁধে। মাঝে মাঝে স্বামী, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে। সে যে দাসী একথা বোঝাতেই সে ব্যস্ত থাকে। তাই সামান্য ত্রুটি হলেই তার গায়ে লাঠি পড়ে। কখনও কখনও নীরব সহ্যকারিনীরও ধৈর্য্য ছুটে যায়। সেই মারমুখী হয়ে উঠে। কাঠি নাচের গানে এমনি একটি সুন্দর পতিবাদী উক্তি-

আয়রে মড়া মরবি নাকি, তোর কি আমি মার খাবো।
অনেক ঠ্যাঙ্গা পিঠে আছে, এবার পরিদান দিবো।।
গায়ের আকল সারা গায়ে, মাথার আকল মুঘুরে।
এবার যদি মরতে আসিস শোধ দিব তোর পুকুরে।।
বিহার আগে কি বলিলি এখন মড়া স্মরণ কর
নইলে কালির থানে পাঁঠার মতো হড়কে দিব মণ্ডুধর।।

অধিকাংশ সংসারে স্বামী নিজেকে বীরপুরুষ ভাবে। পরিবারের অন্যান্য সকলে তাকেই তোয়াজ কের। স্বামী মদ খেয়ে মাতলামো করে। মদের টাকা জোগাতে নিত্য ব্যবহার্য ঘটিবাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। সন্তানদের খাদ্য জোগাড় করতে পারে না। স্ত্রী-পুত্র উপবাসী থাকে। গভীর রাতে মাতাল স্বামী ফিরে এসে স্ত্রীর কাছে ভাত চায়। হতভাগ্য স্ত্রী চুপ থাকে। স্বামীর শক্ত হাতের মার খায়। সে ননদিনীর সাহায্য চায়। কিন্তু পায় না। এমন দুঃখে সে নিজের মৃত্যু কামনা করে। ‘বাঁধনা’ পরবের গানে তার নমুনা পাই-

এরক রাত বিকাই গেল, রাখলি না কিছু সঙ্গেতে।
বাঘের মতো হুকারে দিস, খিদাই ছানা কাঁদে হে।
এত রাত ভাত খাবি তো কিসে মেয়্যা রাঁধে হে।।
আর মেরো না ও সোয়ামী মরলে ভালো হবে কি।
দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে দেখছ কেনো ও পরানের ঠাকুরঝি।।
(আর) পারি না মার খেতে হে।
এবার বিদায় দাওগো সোয়ামী যেদিকে পারি যেতে হে।।

পুরুষ মানুষেরা নির্বিবাদে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। খুশিমতো লোকজনের সঙ্গে মিশে। তাকে বাধা দেওয়ার কেউ থাকে না। কিন্তু কোনো নারী যদি কোনো তৃষ্ণার্ত পথিকের হাতে সামান্য জল ঢেলে দেয় এবং সে পথিক যদি অন্য ধর্মাবলম্বী হয়, তবে পরিবারের পুরুষেরা রে-রে করে আসে। তাতে সাত ছেলের মাকেও ক্ষমা করা হয় না। তেমন বয়স্ক জননীও অপরিচিত ব্যক্তির সামান্য সাহায্য দাত্রীও হতে পারে না। তেমন একটি গান আছে ‘হাপু’ গানে-

আখড়ায় সামালো বলি জোড়া মুসলমান।
বলে পাখি খাও গো জননী।
আমি কি করিলাম হে হরি, আমি সাত ছেলের গর্ভধারিণী
পানি দিলাম ঢালি হে।
অমনি, বুড়ো লাঠি নিয়ে রগদাঁই আসে
খই ফুৎটার মতো দিল দমচক গালি হে
হায় রে) আমি কি করে জানিব মুসলমান।
উহাদের দাড়ি নাই তো ছাতির সমান।

পুরুষ মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে। কোনো নারীই তাকে বাধা দিতে পারে না। দিতে গেলে মোক্ষম উত্তর পায়। এমনকি বুড়ো বয়সে সে পুরুষ যদি দ্বিতীয়বার বিয়েও করে, স্ত্রীর প্রতিবাদ চলে না। সে স্পষ্ট বলে দেয় বাড় বাড়াস না। ‘হাপু’ গানে তার অনেক চিন্তা আছে। ‘ভালুক’ নাচের গানেও তার পরিচয় আছে-

বিয়া করেছি, বেশ করেছি, তোর বাপের কি।
তোর বাপ কি দিয়েছিল গামলা ভরা ঘি।।
তোর দাদা যে হাটে বাটে বনে ঝোড়ে কতক মেয়ে টানে।
(আহা) তার বেলা কি? তার কথাটি কেউ বলেছে কানে।।
হোড়ালমুখী যা শুবি যা মুখে কুলুপ দিয়ে।
আয়রে আয় নতুন বৌ বোমার এবার বিয়ে।।

লোকসাহিত্যের অসংখ্য গানে পুরুষের অত্যাচার নানা দিকে মোড় নেয়। পুরুষ যদি খাদ্যবস্ত্র সংগ্রহ করতে না পারে, ছেলেপুলে যদি খেতে না পায়, তাহলে সে ভারতচন্দ্রের মতোই স্ত্রীকে “অলক্ষণা” বলে খোঁটা দেয়। বাপের বাড়ির নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু নারী মায়ের ভয়ে চুপ করে থাকে।

পুরুষ সংসারের বাইরে কাজর্কম দেখে। নারী দেখে ভেতরের যাবতীয় কর্ম ঝাঁটাপাটা, বাসন ধোয়া, গোবর ফেলা, কাপড়কাচা, রান্না করা, তার সঙ্গে শিশুদের লালন পালন ইত্যাদি। পুরুষ যায় মাঠে লাঙ্গল করতে। এতো করার পরেও স্ত্রী যায় তার খাদ্য বা ‘বাসাম’ নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ কোনোদিন বাসাম দিতে দেরি হলে গুণধর স্বামীর মাথয় খুনচড়ে যায়। এত কষ্ট করেও বয়ে নিয়ে যাওয়া ভাত সে রাগে ছড়িয়ে দেয়। তা দেখে নারী পাথর হয়ে যায়। জীবিকাশ্রয়ী গানগুলিতে তার নমুনা পাই।

নারী বলে-
আমার পুরুষ হাল বাহে, বড় কানালীর ধার গো।
বাসাম দিতে দেরি হলে হালের বোঁঠায় মাওে গো
মরদ বলেই এত অহংকার
এত কষ্টের বাসাম দিলাম ছাড়াই দিল ধার।
ছানা, কোথায় তরা আছিস রে
বাসাম কুড়াতে ক্যানে কেঁদে কেঁদে মরিস রে।।

বাংলার লোকসাহিত্য শ্রমবৈষম্যের কথাও আছে। সেকালে পুরুষ শ্রমিক যে মাইনে পেত নারী তার সমান মাইনে পেতো না। পুরুষ যদি পেত পাঁচ সিকে পয়সা, তখন নারী পেত দশ আনা। অর্থাৎ সমান সময় খেটেও নারী পুরুষের অর্ধেক মাইনে পেত। আবার খাবারও পেত অর্ধেক। পুরুষ যদি পেত এক সের বা এক পাই মুড়ি, নারী পেত আধ সের বা দু’কণা। গ্রামাঞ্চলে এই বন্দোবস্তটি এখনও দেখা যায়। এ বিষয়ে মালিকের যুক্তি ছিল পুরুষের থেকে নারীর শক্তি কম। পুরুষ যতটা উৎপাদন করবে, নারী ততটা পারবে না। এই শ্রমবৈষম্য, এই নারী বঞ্চনা এখনও আমরা প্রত্যক্ষ করি। তাই নারীকন্ঠে সেই বঞ্চনা ও অসন্তোস গান হয়ে উঠেছে-

মালিকের বিচার বটে ভাই।
দিনমান খেটে মরলে দশটি আনা পাই
পুরুষ খেটে দিগুন আনে।
বিচার বটে ভাই।।

‘ভাদু’ ও ‘টুসু’ গানের মধ্যে এই শ্রমবৈষম্য ফুটে উঠেছে-

মাঠ যে দেখতে গেলে ভাদু, মাঠে কেমন দেখিলে।
পুরুষে হাল বাইতে থাকে, মেয়ে পুঁতে বীজতলে।
মাঠ যে দেখতে গেলে ভাদু, মাঠে কেমন দেখিলে।
পুরুষ খাচ্ছে গামলা ভরে মেয়ে খাচ্ছে আঁচলে।।

অর্থাৎ সেকালের সাহিত্যও নারী পুরুষের বৈষম্য, গ্রামীণ কবিরা তুলে ধরেছেন। নারী-পুরুষের সর্বদাই অনুগত থাকবে। পুরুষের সুবিধার্থেই সংসারের সব কাজ তাকে পারদর্শী হতে হবে এবং সেখানেও সামান্য ত্রুটি হলে তার লাঞ্ছনার সীমা থাকবে না। সংসারের কোন জিনিস পুরুষের অনুমতি ছাড়া সে কাউকে দিতে পারবে না।

পুরুষের অনুমতি ছাড়া আত্মীয়স্বজনের সেবা করতে যেতে পারবে না। এবং ছেলেমেয়েদের ভালোমন্দ তার কথার ওপর নির্ভর করবে না। সমস্ত সম্পত্তি পুরুষরই হাতে কেন্দ্রীভূত থাকবে। এই যে পুরুষতান্ত্রিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, এ থেকে বেরিয়ে আসার তার কোনো পথ ছিল না। পুরুষের শাসনে অনুশাসনে, পুরুষ সৃষ্ট নিয়মকানুনের মধ্যেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে। এত শ্রম দিয়েও তার শান্তি সেই। তার পরিশ্রমেই সে খায়। তাই সে চিৎকার করে বলে –

ভাত দেয় না ভাতারে ভাত দেয় গতের।।
কখন্ও সেটা গানে রুপ নেয়-
গতরণ খাটাও গতরণ খাটাও সোনা হেন জ্বলে
গতর না খাটালে সখি সোয়ামীও জ্বলে।।

ভাষাতাত্ত্বিক দেখিয়েছেন নারীও কোনো কোনা ক্ষেএে এই বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। বিশেষ শব্দ ব্যবহারের ক্ষেএে নারী কোনো একটা শব্দকে একবার ভালো বলে মনে করলে তাকে প্রায় ছেড়ে দেয় না। তাই অনেক পুরানো শব্দ তার মুখের ভাষাতে পাই।

১)
ও পোড়া কপালে রে
পোড়ার মুখো কি করেছে।

এবং

২)
মাসাস আমার পিসাস আমার ননদে নন্দাই-এ
ও বোনঝি দেখতো ছুটে কি কাম করিয়ে
ঠাকুরপো ভাসুরপো দেওরপো দল
লাজ দুয়ারে কেমন করে খেলতে থাকে বল।।

৩)
বা ভাতারি বিটি লো বোন ভাতারি ছা
আমাব দেখে জুলিস ক্যানে বৃন্দাবনে যা।।

এমনি অসংখ্য শব্দ আছে অশ্লীল বা অবৈধ সর্ম্পকসূচক। আবার কিছু শব্দ আছে যেগুলি গ্রামীণ মেয়েদের মুখ এখনও শোনা যায়-যেমন ভাই ভায়াদ, ঝি জামাই, ঝঁটাখাকি, ছানাপোনা। এছাড়া এখনও গ্রামাঞ্চলে কোনা স্ত্রী তার স্বামী শ্বশুরের নাম উচ্চারণ করে না। সে উচ্চারণ নাকি অমঙ্গলসূচক। এছাড়া মেয়ে সমাজে খুব প্রচলিত রাতের বলায় তারা কিছুতেই সাপ বলে না তারা বলে ‘লতা’। বাড়িতে চাল না থাকলে বলে চাল বাড়ন্ত হয়েছে। শাঁখা ভঙ্গে গেলে বলে শাঁখা ঠান্ডা হয়েছে। এছাড়া গুজুরফুসুর, গতরখাকি, চোখখাকি, কোরেনারী, দুধর ছেলে, পোয়াতি এবং ছিল ‘লো’ শব্দের ব্যবহার তাদেও কথাবার্তাতে পাওয়া যায়।

যৌন সমস্যা আছে বেহাগীতে (বিবাহ বিষয়ক গানগুলিতে ) ঝুমুর গানে, অনক পুরাকথায়। এক্ষেত্রেও পুরুষ নারীকে শাসন করছে। কখনও কোনো পরব পালে কোনো নারী যদি অন্য কোনা পুরুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং তাতে যদি হাসি-ঠাট্টা-ইয়ার্কি থেকে যায় তাহলে তার স্বামী ক্ষুব্ধ হয়। বোনের মুখে সে কথা যদি রং চড়িয়ে প্রকাশিত হয় তাহলে নারীর রক্ষা থাকে না। উত্তরবঙ্গের মইশাল বন্ধুর গান এবং পশ্চিম রাঢ়ের মাহাতাদের বিবাহগীতে তার নজির মেলে-

কাল গাছে শাল পোঙ্গয়া, কদম গাছে কলি হে।
পরম শালে দেখা হল দুটো কথা বলি হে।
ননদ মুখে কথা শুনে মরদ বলে বেরাঁই যা
যার সঙ্গে যার ভালবাসা সেইখানে তুই চড়ে খা।।
ও ননদি, তোরে শুধু শোধাই রে।
ডেমরা ছুঁড়ি পেয়ে দাদা কাহার সনে মেশায় রে।।

আবার এই ননদিই যখন অন্য পুরুষের গায়ে ঢলে পড়ে বিসৃদশ আচরণ করে স্নানের ঘাটে নির্লজ্জ প্রেমিকের কাছে অনাদৃত হয়ে ওঠে তখন এই দাদাই বোনকে ক্ষমা কর দেয়। বেহাগীতে তার পরিচয় আছে-

মহুল পড়ে ঠেকা ঠেকা, আই ননদি কুড়ালো।
গাছের আড়ে কিসের কথা, কাদেও ঘরে ছোঁড়া লো।।
ছুটে গিয়ে করলি সিনান, গায়ে একটি ঠেকা দে।
খিলখিলায়ে হাসছে ছোঁড়া, একন কোনো ন্যাকা হে।।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত