ছোটগল্প: ঠিকানা
প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০১৯, ২৩:৪৬
একজন মহিলা হারিয়ে গিয়েছে। পত্রিকায় ছবি দিয়েছে বয়স্কা এক মহিলা। চুলে পাক, চোখে চশমা। মুখে বয়স আর অভিজ্ঞতার ভাঁজ। চোখ বোধহয় ঝাপসা। ছানি না কি যেন পড়ে এই বয়সে।
শেষবার দেখা গিয়েছিল বাসার বারান্দায়। যেখানে তিনি নাকি প্রায় বসতেন। কাজ নাকি ছিল না কিছু। বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারেন না। নিজের টয়লেটও নাকি ভুলে অপরিষ্কার রেখে দিতেন। একজন ছুটা বুয়া ছিল। সে নাকি এসব করতে বিরক্ত হত। কে না হয়! যার যার জীবনের যন্ত্রণা নিয়ে সবাই বেঁচে থাকে। এখানে কে কাকে দেখে শুনে রাখবে বলুন? প্রতিটা মানুষের জন্য তো তাহলে আলাদা মানুষ লাগবে! তবু এক রকম চলেই যাচ্ছিল সব।
সময় কাটতে চাইতো না মহিলার। এই সময়ে ২৪ ঘণ্টা বড্ড লম্বা সময়। এক একটা ঘণ্টা যেন এক একটা যুগ। একেকটা দিন আসে তিনি নাকি হা হুতাশ করেন ক্লান্তিতে। তার সাথে থাকা ছুটা বুয়াটা বলেছিল।
সবই বুঝেছিলেন তিনি। বুঝেছিলেন বোঝা হয়ে যাচ্ছেন দিন দিন। যেভাবে সবাই হয়। এক সময়ের সবল মানুষ বয়সের কাছে হার মানে। যে জীবনে কোনোদিন হার মানে নি সেও এসে মাথা নত করে। বয়স এমনই ঘাড়ত্যাড়া!
খেতে পারতেন না ঠিকঠাক। মিষ্টি দিলে বলতেন তিতা। ঝাল দিলে বলতেন বিস্বাদ। মাঝে মাঝে নিচে নামতেন। ডাক্তার নাকি বলেছিলেন একটু একটু হাঁটলে হাঁটুর জন্য ভাল। নিচে একটা মাঠের মত ছিল। তিনি যেতেন সেখানে। এদিক সেদিক একটু হেঁটে বেঞ্চে বসতেন। বেশি হাঁটতে কষ্ট হত। একদিন নাকি সন্ধ্যা হয়ে রাত পার হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তিনি আর উপরে যান না। ছেলে এসে খুঁজে খুঁজে হয়রান। অবশেষে খুঁজে পেয়ে জিজ্ঞেস করল মাকে, কি ব্যাপার তুমি উপরে যাও না কেন? এতক্ষণ এখানে বসে আছো!
মহিলা নাকি হা করে তাকিয়ে ছিলেন ছেলের দিকে। যেন কে কথা বলছে চিনতে পারছেন না। কী আজব চিনবেন না কেন?
ছেলে আবার জিজ্ঞেস করে, মা কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ?
হা করে তাকিয়ে থাকা মহিলা অবশেষে বলেন, তুমি কে? ছেলের উল্টো মাথায় হাত। কি বলে কি এসব! মা আমি, আমাকে চিনতে পারছ না? কি হল তোমার?
খানিক তাকিয়ে থেকে অবশেষে মহিলা বললেন, কিরে আমি এখনও এখানে? চল বাসায় যাই।
মহিলা ধীরে ধীরে উঠেন। ছেলের হা করা মুখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়।
একদিন নাকি বিছানায় করে দিয়েছেন সব। করে তো দিয়েছেন কিন্তু সেখান থেকে যে উঠতে হবে সে কথা নাকি বেমালুম ভুলে গেছেন। বুয়া এসে রেগে মেগে একশেষ। মুখে গজ গজ করলেও কাজ করে সব যত্ন করে। চেঁচিয়ে বলে, আপনি যে সব এখানেই করে বসে আছেন, অসুখ করবে তো। এখানে বসে আছেন কীভাবে? গন্ধ পাচ্ছেন না?
মহিলা আবারও হা করে তাকিয়ে ছিল বুয়ার দিকে। বুয়া কি বলছে কেন বলছে যেন মাথায় ঢুকছে না। যেন বুয়া বাংলা না হিব্রু ভাষায় কথা বলছে।
সে রাতে তিনি নাকি অনেক ঘুমিয়েছিলেন। সকালেও উঠেন নি। কেউ জাগায় নি। ঘুমোচ্ছে ঘুমাক। যখন উঠেন দুপুর গড়াচ্ছে রুমে, বারান্দায়, জানালায়। উঠে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বাইরের দিকে।
হুট করে ঘড়ির দিকে তাকান। ওমা সাড়ে ১২টা। পিন্টুকে স্কুল থেকে আনতে হবে না? ছেলেটা তো স্কুল ছুটির পর মাকে না দেখলে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। হয়েছে একটা মা অন্তঃপ্রাণ ছেলে। তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। এখনই না বের হলে ছেলে কোথায় আবার হারিয়ে যাবে মাকে খুঁজতে খুঁজতে!
মহিলা নাকি একটা ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন। গেটে নাকি দারোয়ান জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় যান একা?
মহিলা নাকি এক কড়া দৃষ্টি দিয়ে বলেছিল তুমি জিজ্ঞেস করার কে? দারোয়ান হা হয়ে গেলো। মহিলাও গজগজ করতে করতে বের হয়ে গেলেন গেট পেরিয়ে। কে না কে এসে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাই? সাহস কত বড়!
মুখে রাগ বিরক্তি আর ছেলের জন্য চিন্তা নিয়ে রাস্তায় বের হলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর মনে হল, স্কুলটা যেন কোথায়?
মহিলা এদিক তাকান। ওদিক তাকান। গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ি ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। কোনদিকে যাবেন? স্কুলটা বামে ছিল না? নাকি সোজা? মনে করতে পারছেন না। ভয়ে তিনি ব্যাগটা বুকে চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে হল পিন্টুর বাবাকে ফোন দেই। ওমা ফোন নাম্বার কোথায়? মনে আছে? কই মনে পড়ছে না তো। নাম্বার যেন কি?
বিহ্বল চোখে তিনি চারিদিকে তাকান। কোথায় যাবেন তিনি। কোনদিকে গেলে পাওয়া যাবে ঠিকানা?