ছোটগল্প: চালু
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৯, ১৫:২৪
এখানে আমার আসা হয় মাঝে মাঝে। ক্ষণিক সময় পেলে এখানে কিছু ঘষা মাজার জন্য আসি। কোণের একটা টেবিল নেই। মিনিমাম দুই কাপ কফির অর্ডার দেওয়া থাকে। একটা শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা পর আরেক কাপ দেওয়ার কথা। ওয়েটাররা আমাকে চিনে। ম্যানাজার হাই হ্যালো করে যায়। কফি আর আঁকিবুঁকি, আঁকিবুঁকি আর কফি। বেশ লাগছিলই আজকে। বাইরে গুমোট কালো আর তুমুল ঝড়। আমি ছাড়া দুই কি তিনজন মনে হয় আছে এখন রেস্টুরেন্টে।
এভাবেই সময়টা যাচ্ছিলো হঠাৎ কঠিন এক বজ্রপাতের শব্দ। একটু ভয় পেয়ে নড়েচড়ে বসলাম। সামনে তাকাতে দেখি একজন চুপচাপ বসে আছে বাইরে তাকিয়ে। কাঁচের জানালা ভেদ করে বাইরের নিকষ কালো আর তেড়ে আসা বৃষ্টি দেখছে। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে হাতটা থুঁতনিতে রেখে কি যেন পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছে। আমি তাকালাম, গভীরভাবে।
পরনে সাদা শার্ট, কালো জিন্স। হাতে সম্ভবত আই ওয়াচ। হাত এবং কাঁধ অত্যন্ত পুরুষালী। দূর থেকেও নজর আকৃষ্ট করার মত। চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করা। তবে ঘন চুল। চোখে চশমা, মুখে চাপা দাড়ি। পায়ে চকচকে বুট। বয়স আনুমানিক চল্লিশ এর কাছাকাছি। সেও কফি অর্ডার করেছে। এইমাত্র ওয়েটার দিয়ে গেলো টেবিলে। আমার এই লোকটিকে পছন্দ হয়েছে। একটা ব্যক্তিত্ব আছে বলে প্রথম দর্শনেই বুঝা যায় কিছু মানুষদের ক্ষেত্রে। এ তাদের মধ্যে পড়ে।
কফি শেষ করলাম। উঠে এসে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কেউ হয়ত জানতে চাইতে পারে সংকোচ করেনি? মেয়েরা সাধারণত উঠে আসে না। তাদের বলবো, সংকোচ থাকলে স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না।
- এক্সকিউজ মি, আমি কি এখানে বসতে পারি?
সুদর্শন পুরুষটি থুতনি থেকে হাত সরাল, আমাকে দেখলো চোখ তুলে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই অবাক হলো।
- এখানে? হ্যাঁ বসুন।
আমি বসলাম পায়ের উপর পা তুলে যেমনটা বসে থাকি সব সময়। সুদর্শন পুরুষটি তাকালো, একটু হাসলো এবং আবার জানালার দিকে তাকালো। দেখলাম তার কফি শেষ। আমাকে আরেক কাপ দেওয়ার সময় হয়েছে।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আরেক কাপ কফি নিবেন?
পুরুষটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো, কেন আপনি অফার করছেন নাকি?
- হ্যাঁ করছি। আমি মিল্ক কফি নিবো, আপনি?
সে হাসলো, হাসি দিয়ে অবাক হওয়া লুকালো, কিন্তু ধরা খেয়ে গেলো।
- আমিও মিল্ক কফি।
এবার তার দেখার পালা। সে নড়েচড়ে বসলো। কথা শুরু করলো।
- আপনি কি এখানে প্রায় আসেন?
- না মাঝে মাঝে। যখন এমনিতেই একা থাকতে ইচ্ছে করে।
-ও আচ্ছা। চোখ নামিয়ে সে আবার বলে, একা থাকতে চাইলে আমার টেবিলে এসে বসলেন যে? টেবিল তো প্রায় সব খালি।
- ইচ্ছে করলো। আমার বাঁকা ঠোঁটের উত্তর।
- ইচ্ছে করলো কেন? স্পষ্ট জিজ্ঞাসা।
বুঝলাম সেও এভাবে খেলতে ভালোবাসে। পছন্দ ঠিকই হয়েছে।
- সেটার এখনো কোনো স্বচ্ছ উত্তর নেই। আমি বসেছিলাম ঐ কোণের টেবিলে। খানিকবাদে আপনি এলেন এই ঝড়ের রাতে। আপনাকে আকর্ষণীয় এবং ইন্টারেস্টিং লেগেছে আমার। তাই।
এমন স্পষ্ট উত্তরের সে আশা করেছিল কিনা জানি না। তবে তার চোখের ভ্রু একটু কপাল ছুঁলো।
ভ্রু নামিয়ে বলল, আমাকে প্রথম দেখেই ইন্টারেস্টিং লাগল আপনার?
- প্রথম দর্শনে প্রেম হয় না, আকর্ষণ হয়।
- কিন্তু আমি আপনাকে খেয়াল করি নি।
দারুণ লেগেছে কথাটা আমার। সে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে না।
- এখন? এখন খেয়াল করছেন?
- করতে তো বাধ্য হচ্ছি। সামনে এসে বসলে কি খেয়াল না করে পারা যায়?
- না আপনি চাইলে আমি চলে যেতে পারি। যাবো?
- আসার সময় আমার অনুমতি তো নেন নি।
- কিন্তু আমার আসা যদি কারো বিরক্তির কারণ হয় তাহলে চলে যাওয়াই উত্তম।
এবার সে একটা মোলায়েম হাসি দিলো। আমার ভেতরটা সেটা দেখে জুড়িয়ে গেলো।
কফি এলো। চুমুক হলো। জানালায় তাকিয়ে দুজনেরই বৃষ্টি দেখা হলো। যেন বৃষ্টিরা ছুটোছুটি লাগিয়ে দিলো আমাদের কথাবার্তা শুনার জন্য।
সে নিঃসঙ্কোচে বলল, আমি ডিভোর্সড।
কাপ নামিয়ে বললাম, সেটা মন্দ নয়।
সে হো হো করে হেসে উঠল। আর আমার বয়স?
- সেটা আরো চমৎকার।
সে হাসতেই থাকল। এবং তাকিয়ে রইল।
- কী?
- এমন আমি প্রথম দেখেছি।
- কেমন?
- এই যে তুমি সরি আপনি নিজেই উঠে এলেন আমার কাছে। এমনটা মেয়েরা করে না।
- তারা কি করে?
- অপেক্ষা। কখন কেউ আসবে আর তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে।
- জীবন অপেক্ষা করার জন্য খুব ছোট।
- সেটা মেয়েরা বুঝে?
- আমি বুঝি। আমিও মেয়ে। এবং আমার যা ভাল লাগে যা করতে চাই তা করার চেষ্টা করি।
- এখন কি করতে ইচ্ছে করছে?
- আপনার সাথে ড্রাইভে যেতে।
- খানিকের পরিচয়ে?
এবার আমি হাসলাম। ধরুন আমি যদি আপনি হতাম। আপনি যদি আমি হতেন তাহলেও কি কথাগুলো এমন হতো?
- আমাকে লম্পট ভাবা হতো। সৎ উত্তর তার।
খানিক ভেবে বললাম, তাহলে আমাকেও সেইম ভাবছেন এখন।
- না।
- কেন?
- মেয়েরা আসে না। তারা ভীতু। তুমি নও। সাহসী। সাহসীরা লম্পট হয় না।
- এখনই বুঝে গেলেন?
- খানিকটা।
তিনি গভীরভাবে আমার দিকে তাকালেন। আমার ভাল লাগলো। শিহরণ জাগলো। মানুষটিকে আমি পছন্দ করেছি। এর সঙ্গ আমি কামনা করছি। এর জন্য “আমি প্রথম কথা বললে আমাকে চালু ভাববে” নীতিতে চলতে চাই না। কে কি ভাবলো সেই ভয় থেকেই যদি বের হতে না পারলাম, বাঁচলাম কিভাবে আর?
- চলুন যাওয়া যাক।
আমরা দুজনেই উঠলাম। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিলো অল্প।
পার্কিং এ গেলাম পাশাপাশি হেঁটে। তার গলার আওয়াজ পেলাম গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে।
- আমরা কি এভাবেই বিদায় নিবো?
আমি ফিরলাম, বললাম, না, আপনি চাইলে আমার বাসায় আসতে পারেন এখন। আমার সাথে। আমি ডিভোর্সড নই, তবে কুমারীও নই আবার বিবাহিতও নই।
সে তাকিয়েই রইল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে।
তার দৃষ্টির উত্তর দিলাম আমি, যদি না আপনি আমাকে 'চালু' ভাবেন।