নারী দিবসের গল্প

পড়ন্ত বিকেলের আকাশ

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০১৯, ২৩:২৩

সামারা তিন্নি

গভীর মনোযোগ দিয়ে আমি তার কাজকর্ম দেখছি। এমনিতে আগোছালোর চূড়ান্ত শিরোমনি হলেও তার প্রিয় কাজ সে খুব যত্ন নিয়ে করে। প্রথমে কিছু প্রোটিনের পাউডার একটা প্লাস্টিকের বোতলে ভরে সে ঝাঁকাঝাঁকি করলো। এই প্লাস্টিকের বোতল প্রোটিন শেক বানানোর জন্যই কেনা হয়েছে। বোতলের মাঝে একটা স্প্রিং এর বল। তার ঝাঁকুনির চোটে বল দ্রুতগতিতে উপর-নিচ করছে। পানি আর প্রোটিনের গুঁড়ো একসাথে মিলেমিশে রসায়নের জটিল গোলকধাঁধা সৃষ্টি করছে। তরল আর শুকনো পদার্থ মিশে হলদেটে সাদা বর্ণের থকথকে এক বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এক নিঃশ্বাসে পুরোটা খেয়ে সে দাঁত বের করে হাসলো। 

“কী হয়েছে? এভাবে গালে হাত দিয়ে কী দেখো?” 

প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবতে হয়। চমৎকার একটা উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু মাথায় কিছু আসছে না। আমার সবসময় সুন্দর করে কথা বলতে মন চায়, রহস্যময় উত্তর দিতে ইচ্ছে করে প্রশ্নের পিঠে; নাটকে দেখা সুন্দর নায়িকাগুলোর মত। সামান্য ‘ভাত খেয়েছো’ ধরনের প্রশ্নের উত্তরও কী অপূর্ব করেই না দেয় তারা! কিন্তু আমার কখনো সেসব কথা মাথায় আসে না, ভাত খেয়েছো প্রশ্নের জবাবে আমি হু বা না খাইনি বলেই কাজ সারি। মাঝে মধ্যে যে উত্তর মাথায় আসে না, তা নয়। কিন্তু লজ্জ্বায় বলতে পারি না। প্রশ্নকর্তার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার স্বভাব আছে। কিছু বললেই সে ব্যঙ্গাত্মক কিছু বলে বসে। আমি নিজেই নিজের কাছে ছোট হই, কেন আমি এত সাধারণ? 

“না তো, কিছু দেখি না।” বলেই ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। এতক্ষণ ভেবে আমার মস্তিষ্ক বুঝি এই বাক্য সাজালো? 

“ভাত খাওয়া বন্ধ করো, বুঝলে? এখন তো আছো তবলা, আর ক’দিন পরে হবে ঢোল। রাস্তা ঘাটে যখন হাঁটাহাঁটি করবে তখন মানুষ ঠকাস করে এসে মাথায় বাড়ি দেবে ঢোলে বাজনা বাজাতে।” 

কথাটা বলে হাসতে হাসতে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভবত আমাকে ঢোল কল্পনা করেই সে হাসি থামাতে পারছে না। আমার অবশ্য হাসি পায় না, অপমানবোধ হয়। তারপরেও জোর করে হাসি। সংসার করতে গেলে অনেক ছোটখাট জিনিসকে উপেক্ষা করতে হয়। এটা আমার কথা না, আমার খালার কথা। তার প্রায় চল্লিশ বৎসরের সংসার। এত অভিজ্ঞ মানুষের কথা না শোনাটা বোকামি বিধায় আমি অক্ষরে অক্ষরে তার উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করছি। সমস্যা হচ্ছে, কোন সমস্যা ছোট আর কোন সমস্যা বড় - এই দুইয়ের মাঝে বড্ড হিমশিম খাই। পৃথিবীর এত অসংখ্য মানুষ বিয়ে করেছে, কিন্তু তাদের কারো সময় হয়নি একটা নিয়মের বই লেখার। আমার মত অনভিজ্ঞ মানুষগুলো প্রতিনিয়ত অস্থিরতায় ভোগে ভুলেও ভুল না করার এক ভয়ানক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে। 

“তোমার জন্য একটা ডায়েট প্ল্যান করতে হবে। হাঁটাহাঁটিতে তোমার কিছুই হচ্ছে না। অবশ্য দোষ তোমার না, তোমার বাবা-মার। তারা যে খাইয়ে খাইয়ে একটা খোদার খাসি বানাচ্ছেন তোমাকে, সেটা চোখেই পড়লো না কারো?” 

আমি চোখের জল লুকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, “একদমই ঠিক হয়নি ব্যাপারটা। কারো না কারো তো চোখে পড়া দরকার ছিল।” 

তাকে এবার অত্যন্ত উৎসাহী দেখা যায়। সঠিক কথা বলার আনন্দে ঝলমল করতে করতে বলে, “তোমার বন্ধু-বান্ধবই বা কেমন? আমাদের ক্লাসে যেগুলো তোমার মত ছিল সেগুলোকে তো এমন টিজ করতাম যে সেগুলোর জীবন ঝ্যাড়ঝ্যাড়া হয়ে যেতো। একবার জানো কী হয়েছে?” 

আমি নির্জীব কণ্ঠে বলি, “কী?” 

মানুষের জীবন ঝ্যাড়ঝ্যাড়া করার আনন্দে সে আমার কণ্ঠস্বর খেয়াল করলো না। বিরাট এক কাজে সে অংশীদার ছিল এমন গর্বিত স্বরে বললো, “মিতা নামে আমার ভার্সিটিতে একটা ক্লাসমেট ছিলো বুঝেছো। তোমার চেয়েও খারাপ অবস্থা। ওর নাম ছিল হোঁতকা। নামটা কিন্তু আমি দিয়েছিলাম! ক্লাসে ও ঢুকলেই আমরা পিছন থেকে সুর করে গাইতাম হোঁতকা রে হোঁতকা, তুই কেন এত ভোটকা। শেষপর্যন্ত ও ক্লাসে আসা ছেড়ে দিয়েছিলো। এক ইয়ার লস দিয়ে আবার পরের ব্যাচে ঢুকেছে।” 

সুর হয়ে বিশ্রী ছড়াটা একবার গেয়েই হাসতে হাসতে সে ভেঙে পড়ে। আমি ব্যথিত চোখে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। মনে মনে তার চেহারার খুঁতগুলো ধরে কুৎসিত কোন কথা বলার চেষ্টা করেও পারি না। একে তো আমার এভাবে কারো খুঁত ধরে কথা বলার অভ্যাস নেই, তারওপর সে দেখতে বেশ ভালো। এই যে সে হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরছে, তাতেও তাকে দেখতে ভালো লাগছে। সানগ্লাস পরা কিছু ছবি আছে তার যেগুলোতে তাকে দেখতে নাটকের নায়কদের মতই লাগে। হালকা দাঁড়িতে কী সুন্দরই না তাকে লাগছে! 

এই ‘সে’ ব্যক্তিটি হচ্ছে ইমন, যার সাথে সাড়ে তিন বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমাকে ইমন একেবারেই পছন্দ করে না। তারপরেও হাসিমুখে সংসার করছে। আমি ইমনকে খুবই পছন্দ করি, তারপরেও ছলছল চোখে সংসার করছি। এ এমন এক অনুভূতি যেটা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। ভালোবাসার মানুষের প্রত্যাখ্যানের কষ্ট আমি অনুভব করতে পারি। চিরজীবন যার সাথে থাকার জন্য চলে এসেছি তার ভালোবাসা না পেয়েও পাবার অভিনয় করার কষ্ট আমি কোনদিনও জানতে চাইনি। যেচে পড়ে প্রকৃতি আমায় এ জ্ঞানলাভে বাধ্য করেছে। 

ইমন যে আমাকে পছন্দ করে না সেটা আমি টের পেয়েছিলাম বিয়ের রাতেই। ইমনের সাথে বিয়েটা আমার হয়েছিলো একদম নাটকের মত করে। আমি আবার বাংলা নাটকের পোকা। একশ চ্যানেলের দেড়শ নাটকের প্রায় প্রত্যেকটাই আমি দেখি। আমার প্রাণের বন্ধু তৈয়বাও ছিল একই রকম। ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে আলোচনা করতাম আর ইচ্ছেমত রঙিন সুতো দিয়ে স্বপ্নের নকশা জাল বুনতাম। ইমনের সাথে বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো তৈয়বা। আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “সুবর্ণা, তুই যে নাটকের নায়িকা হয়ে গেলি রে!” 

এই যাহ, নিজের নামটা বলে দিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম বলবো না। সুবর্ণা নামটা শুনলেই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ধারালো মুখশ্রীর এক নারীর মুখ ভেসে ওঠে কিনা সবার চোখে। আমি মোটেই ওরকম নই। এই নাম আমার কপালে জুটেছিল আমার দাদীর বদৌলতে। জন্মের পর নাকি আমার দুধে আলতায় রঙ ছিল। দাদী কোলে নিয়েই বললেন, সুবর্ণা! ভাগ্যি দাদী এখন বেঁচে নেই। তার দেয়া নামের এমন নিদারুণ অবস্থা দেখলে তিনি কোথায় লুকোতেন কে জানে! 

ইমনের সাথে আমার পারিবারিক সম্বন্ধে বিয়ে। ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকে, মাস্টার্স করছে ফাইন্যান্সে। এরপরে মার্কেটিং এ পিএইচডি করবে। ছেলের রেজাল্ট অত্যন্ত ভালো। ছেলের পরিবার ভালো। ছেলে দেখতে সুন্দর। আমার বাবা-মা তাদের মেজ কন্যার জন্য এমন ছেলে খুঁজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আমার ছোট বোন তাদের থেকেও খুশি। আমার কারণে সে তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারছিলো না। আমার বড় ভাই আনন্দ সামলাতে না পেরে ছেলের জন্য দেড় লাখ টাকা দিয়ে বিয়ের শেরওয়ানি কিনলো। মাত্র একদিন পরার জন্য এত টাকা খরচে আমি নিজেও একটু ভ্রু কুঁচকেছিলাম। কেউ আমার কথায় পাত্তা দিলো না। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, কেউ আমাকে জিজ্ঞেসও করলো না যে ছেলে আমার পছন্দ কিনা। আমি মোটামুটি নিশ্চিত কেউ ইমনকেও এই প্রশ্ন করেনি। তাকে সম্ভবত আমার শাশুড়ি ফোন দিয়ে বলেছিলেন, “চলে আয় বিয়ে করতে, মেয়ে ঠিক করেছি।” সে অবশ্য আমার ছবি দেখে অনেক প্রতিবাদ করেছে, তার আপত্তি ধোপে টেকেনি। কারণ আমার আম্মা আর ইমনের মা ছোটবেলার বান্ধবী। দীর্ঘ বারো বছর পরে দেখা হবার পর তারা আর পরস্পরকে ছাড়তে চাননি। আমার আম্মাকে আমার শাশুড়ি যে অসম্ভব পছন্দ করেন সেটা আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যেদিন তিনি আমাকে দেখে বললেন, “এত মিষ্টি মেয়ে তোর আর আমি ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজে মরি!” 

আমি যে মিষ্টি মেয়ে সে আমি আগেও অনেক শুনেছি, তাই সে নিয়ে তেমন আনন্দে উৎফুল্ল হইনি। তবে বিয়ের কথা শুরু হবার পর অনেক রূপচর্চা শুরু করেছিলাম। হলুদ, বেসন আর হরেকরকমের সবজী সকাল-বিকাল মুখে ঘষাঘষি চলতে থাকলো। কারণ ততদিনে ইমনের ছবি দেখে ফেলেছি আমি। ইমনের উজ্জ্বল ফর্সা রঙের পাশে অন্তত শ্যামবর্ণ না হলে কেমন করে হবে? সকল নামি দামী বিউটিশিয়ানদের সব উপদেশ আমার কাছে এসে নেতিয়ে পড়লো, আমি যেমন ছিলাম তেমনই রইলাম। 

বিয়ের আগে সবাই একটু ঘুরতে টুরতে বের হয়, লাজুক দৃষ্টি বিনিময় হয়। গালে আইসক্রিম লেগে আছে এই অজুহাতে সেই অদৃশ্য আইসক্রিম মোছার চেষ্টা করা হয়। আমি সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ কিনলাম, এই রঙে আমাকে সবচেয়ে বেশি মানায়। ইমনের তরফ থেকে কোন সাড়া এলো না। লজ্জ্বার মাথা খেয়ে আমিই মাকে বললাম। শাশুড়ি উত্তেজিত হয়ে পারলে বিয়ের আগেই হানিমুনের ব্যবস্থা করে ফেলেন আরকি। ইমন এলো না। সে নাকি বিয়ের আগে ঘোরাঘুরি পছন্দ করে না। ইমনের সম্মান এক লাফে এগারো তলা ছুঁয়ে ফেললো আমাদের বাড়িতে। বাহ, এমন ছেলেই তো চাই মেয়ের জন্য। 

মিথ্যে বলে নিজেকে ঠকিয়ে লাভ নেই, আমার ইমনকে আসলেই পছন্দ হয়েছিলো। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলে যেসব ক্ষেত্র দেখা হয়, প্রতিটিতেই সে গোল্ডেন এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্র। বেশ রক্ষণশীলভাবে বড় হওয়ায় প্রেম করার সুযোগ তেমন একটা হয়নি আমার। যে দুই একটা চিঠি এসেছিলো, সবই পড়েছে ভাইয়ার হাতে। এরপর প্রেম জানালা দিয়ে পালিয়েছে। ছেলেগুলোকে ঠিকমত দেখার সৌভাগ্যও হয়নি। প্রথমবারের মত প্রেমে পড়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমি। রবি ঠাকুর আর শরৎচন্দ্রের নায়িকা হয়ে উঠেছিলাম আমি এক পলকেই। লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেমের স্বাদ পাইনি, সবার সম্মতিক্রমে পাওয়া ভালোবাসার কল্পনায় মেঘে ভাসছিলাম। 

বাসর রাতেই টের পেলাম কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। মুখে কিছু না বললেও ইমনের ভাবভঙ্গিতেই বেশ বুঝতে পারছিলাম যে সমস্যাটা সম্ভবত বড়ই। আমাকে ঠিক পছন্দ হয়নি ইমনের। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম মাত্র তিনমাস, আমার ভিসা হতে যতদিন দরকার আরকি। ইমন চলে যাবার জন্য অস্থির, আমার শাশুড়ি চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। মায়ের মুখের উপরে কিছু বলতে না পেরে গোমড়া মুখে সে ঘুরে বেড়ায়। শ্বশুরবাড়িতে আমাকে সবাই খুব আদর করতো; শুধু যার জন্য ও বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক, সেই মানুষটি ছাড়া। 

সিডনিতে পা দিয়েই ইমন সম্পূর্ণ বদলে গেলো। দেশে মা-বাবার জন্য হলেও তার আনন্দে থাকার অভিনয় করতে হতো, এখানে সে স্বাধীন। সিডনির ভ্যাপসা কিন্তু মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সে হাসিমুখে আমাকে বললো যে আমাকে ঠিক তার পছন্দ হয়নি প্রথমে, কিন্তু এখন ভেবে দেখছে যে আমি মেয়ে খারাপও না। সম্ভবত সংসার করা যাবে। একটু এদিক সেদিক বদলে নিলেই হবে। আমি তখন বদলাতে এক পায়ে খাড়া। নাটকগুলিতে স্পষ্ট করে দেখায় যে স্বামীর ভালবাসা না পাওয়া অত্যন্ত অপমানজনক। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাল আমলের শীর্ষেন্দু সবাই এই কথা লিখেছেন। ছোটবেলা থেকেই সবার আদরে বোকা-বোকা হয়ে বড় হয়েছি। ছাপার অক্ষরকে বেদবাক্য বলে মানি। অপমানিত হতে চাইলাম না, তারচেয়ে নিজের সত্ত্বাকে বদলানো অনেক বেশি কাম্য মনে হলো। 

কিন্তু বললেই কি আর বদলানো যায়? খোদা যে কী কোঁকড়া চুল দিয়েছেন আমাকে, গরম লোহা দিয়ে প্রতিদিন টেনেও তা সোজা হয় না। গোলাকার মুখও টেনে টুনেও লম্বা হলো না। ইমন হতাশ হয়ে আমাকে তার এই বান্ধবীর মত হতে বলে, ওই বান্ধবীর কাছ থেকে জামাকাপড় পড়ার কৌশল শিখতে বলে। আমি মনোযোগী ছাত্রীর মত সবার কাছেই শিখতে গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু একশতে তেত্রিশও পেলাম না। সবার তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসিতে বুঝলাম আমি ওদের মত না। আমার থেমে থেমে বলা ইংরেজিতে আমাকে হাস্যকর শোনায়। আর কী অদ্ভুত সব কাণ্ড, বাঙালি মেয়েরাও তড়বড় করে ইংরেজিতে কথা বলে নিজেদের মাঝে। শাড়ির জন্য প্রাণ কাঁদে, ফাল্গুনে হাতে বেলি ফুলের মালা পরার জন্য অস্থির লাগে - কারো এতে কিছু এসে যায় না। ইমন আমার প্রতিটি ত্রুটি ধৈর্য সহকারে নিপুণ দক্ষতায় ধরিয়ে দেয়। ভরা আসরে সবার সামনেই উচ্চস্বরে আমার দুর্বলতাগুলো সবাইকে জানিয়ে আসর জমায়। সবাই হাসিতে ভেঙে পড়ে, “ইমন ভাই, আপনি যে এত হাসাতে পারেন! ভাবী কিছু বলে না, তাই?” আমিও হাসি, হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে আসে। বুঝতে পারি না এই অশ্রুজল কী আনন্দের না বেদনার কিংবা তীব্র অপমানবোধের। অথবা শেকড়বিহীন এক তরুলতাকে বাসায় ফুলদানির মাঝে পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টার করুণ পরাজয়। 

সবাই আমাকে বারে বারে শোনায়, আমার কত ভাগ্য যে ইমনকে পেয়েছি। প্রথম প্রথম হেসেছি। লাজুক মুখ করে বলেছি, “তা আর বলতে!’। ধীরে ধীরে ফিকে হয়েছে সে লাজুকতা, বিষণ্ণতা গড়িয়ে নেমেছে আমার ললাট আর কপোল বেয়ে। কেউ বলে না যে ইমনও কত ভাগ্যবান আমাকে পেয়ে। সবাই শুধু চোখে আঙুল দিয়ে বোঝায়, মূল্যবানের মূল্য না চুকিয়ে আমি ভাগ্যের জোরে পেয়ে গেছি। ছোট আর বড় সমস্যার মাঝে হা পিত্যেশ করে মরি নিরন্তর। বলতে লজ্জ্বা লাগছে, কিন্তু তারপরেও বলি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রাগাতাম ইমনকে যেন রেগে গিয়ে সে আমাকে একটা চড় দিয়ে বসে। আমি জানি যে চড় মারা একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যাকে ফুটিয়ে তুলে ইমনকে আমি তার প্রাপ্য স্বাধীনতা দিতে পারবো। মনের মিল হচ্ছে না, এই সমস্যা কি কেউ কানে তোলে? 

ইমনের ডায়েট প্ল্যানের অত্যাচারে আমার রাতে ক্ষুধায় ঘুম আসেনা। আরো সাত কেজি ওজন না কমালে ইমন আমাকে নিয়ে কারো সামনে যেতে পারছে না। ইমনের দুঃখেই কাঁদি আমি। আহা বেচারা, বিয়ে করে কী ঝামেলাতেই না পড়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে ইমন একবার তার মাকে বলেছিলো বটে ডিভোর্সের কথা। সে জানতো না যে দরজার ওপাশ থেকে আমি সব শুনছি। শাশুড়ির চিৎকার ফোনের এপাশ থেকেও আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি শাসাচ্ছিলেন যে বউ ছাড়লে মা আর পরিবারকেও ছাড়তে হবে। ইমনের হতাশ মুখটা মনে হলে এখনো মনটা খারাপ হয় আমার। পরিবারকে ছাড়বে এত সাহস কই তার? 

ইমনকে সেবার বললাম সবাইকে বলে দিতে যে আমাকে তার পছন্দ নয়। ইমন জিভ কাটলো, নাহ অসম্ভব। এ বললে সমাজে অনর্থ হবার ঘোরতর সম্ভাবনা। শারীরিক গঠন পছন্দ না হবার জন্য বউ ছাড়লে লোকে মন্দ বলবে, বলবে ইমন বর্বর। এখানকার মুক্তমনাদের গঠন করা সাংস্কৃতিক গ্রুপের একজন কর্মঠ সদস্য ইমন। নারীদের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য করা অনুষ্ঠানে ভরাট কণ্ঠে ইমন উপস্থাপনা করে। সে বুঝি পারে বউয়ের চেহারা পছন্দ নয় এই অজুহাতে ডিভোর্স নিতে? তাই পাছে লোকে কিছু বলে -এর ফাঁদে পড়ে সাড়ে তিন বছর ধরে সংসার করছি আমরা। কিন্তু এতদিনেও আমি অভ্যস্ত হতে পারিনি ইমনের তীর্যক মন্তব্যের আঘাতে। প্রতিবারই চোখে জল আসে। হায়, এত জল যে পোড়া চোখ কোথায় লুকিয়ে রাখে কে জানে! 

ইমনকে হাসতে হাসতে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে দেখে আমার জীবন অর্থহীন মনে হতে থাকে। অনেকদিন আমি এভাবে আনন্দে হাসি না। আমার হাসিও ইমনের পছন্দ না। হাসলে নাকি আমাকে ভেটকি মাছের মত দেখা যায়। আমার অনেক সৌভাগ্য যে ইমনের কাছে তেমন টাকা নেই। নতুবা এতদিনে সম্ভবত দুই-চারটি প্লাস্টিক সার্জারি আমার চেহারায় হয়ে যেতো। ইমন সেদিন লাইপোসাকশনের খবর নিচ্ছিলো ডাক্তারের কাছে। ইমনকে পাত্তা না দিয়ে ডাক্তার আমাকে দেখে হাসিমুখে বলেছে যে স্বাস্থ্যকর খাবারেই হবে, কোন অপারেশনের দরকার নেই। বিদায় দেবার সময় হাতে একটা চকলেট গুঁজে দিয়েছে, চোখ টিপ দিয়ে বলেছে, “চিট মিল।” ইমন বাইরে এসে চকলেট ছুঁড়ে ফেলেছে। 

প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে, এক চামচ চিনিও খাইনি। আমার সমস্ত চিন্তা এখন এমন খাদ্যকেন্দ্রিক হয়ে গেছে যে নিজেরই লজ্জ্বা লাগে। খেতে ভালোবাসি বলে বাসায় মাছের মুড়োটা, মিষ্টির প্রথম বাটিটা সবাই আমাকেই দিতো। খাবার খেলেও যে মনে অপরাধবোধ হতে পারে, ইমনের সাথে না থাকলে কখনো বুঝতেই পারতাম না।  

ইমন হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলে, “তোমাকে আজকে এত চিন্তাবিদ দেখা যাচ্ছে কেন? কী চিন্তা করছো?” 

“আমি ভাবছি একটা কাজ নেবো।” 

ইমন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসে, “তোমাকে কাজ কে দেবে? হ্যাঁ, রান্নাঘরে বাসন মাজামাজি টাইপ কাজ পাবে অবশ্য। নাহলে তোমার যে ইংলিশ, শুনে সবাই হাসতে হাসতেই মরবে।” 

ইমনের কথা হজম করে যথাসাধ্য স্বাভাবিক কণ্ঠ বজায় রাখি, “আমি একটা কাজ আসলে পেয়ে গেছি।” 

মুখ হা হয়ে যায় ইমনের, “কী কাজ পেলে?” পরক্ষনেই দুই চোখ উলটে ভেংচি দেয়, “রাস্তা ঝাড়ু দেয়া?” 

“না। আমি তো বোটানিতে পড়েছি। রোমার্সে ম্যানেজারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ পেয়েছি। রিসেপশন মাঝে মাঝে সামলাতে হবে, কিন্তু মূল কাজ গাছের রক্ষণাবেক্ষণ, কাস্টমারকে ফুল আর গাছের যত্ম এসব নিয়ে বোঝাতে হবে।” 

ইমন চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। আমি জানতাম রোমার্সের নাম শুনলে ইমন হতভম্ব হয়ে যাবে। প্রথম কাজ হিসেবে এত বড় নার্সারির চেইনে ঢোকা আসলেই বড় ব্যাপার। 

“ইন্টারভিউ? ইন্টারভিউ হয়েছে?” 

“হবে না কেন?” আমি শান্তভাবে বলি, “ইন্টারভিউ ছাড়া কি কাজ হয়?” 

“তোমার ইংরেজি বুঝতে পারলো কী করে!” 

আমি হাসি, “আমার ইংরেজি শুধু তুমিই বুঝতে পারো না। বাকিরা ভালোই বোঝে। ইংলিশ তোমার সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তো, তাই বোধ হয় একদম শুদ্ধ না হলে বুঝতে পারো না।”  

ইমনের রাগে মুখ লাল হয়ে যায়, “এক কাজ পেয়ে বেশি ঢং হয়েছে? ভাবছো পৃথিবী জয় করেছো? কাজ করতে পারবে না।” 

আমি অবশ্য জানতাম এরকম কিছু একটা হতে পারে। তাই একটুও উত্তেজিত না হয়ে বললাম, “কেন?” 

“পারবে না, ব্যাস পারবে না। তুমি সেখানে গিয়ে কী কাণ্ড করে আসবে আর ঠিক আছে? দেখা যাবে বিরাট কোন ক্ষতি করে দেবে, আর সেটার মাশুল দিতে হবে আমাকে। আর খেতে পরতে পাও না তুমি? কিসের জন্য তোমার টাকা দরকার?” 

“না পাই না।” 

ইমন চেঁচিয়ে ওঠে, “কী বললে? খেতে পরতে পাও না?” 

আমি মুখ শক্ত করি, “না ইমন, তুমি আমাকে খেতে দাও না। শুধু যে খেতে দাও না তাই না, তুমি আমাকে মানসিকভাবে চাপে রাখো। উঠতে বসতে খোঁটা দাও। তোমার সাথে থাকতে থাকতে আমি ক্ষুদ্র একটা মানুষ হয়ে গেছি, ভীতু একটা মানুষ হয়েছি। তুমি আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করোনি, সেটা আমার দোষ না। আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলিনি। তোমার উচিত ছিল তোমার মাকে শক্ত করে জানানো যে তোমার আমাকে পছন্দ না। সত্যি বলতে কী, তুমি আমার কাছে অপরাধী।” 

ইমনের চেহারা দেখে আমার একটু মায়া লাগলো। হা করে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। সে সম্ভবত বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমি এসব তাকে বলছি। জোর করে মায়া ভাবকে তাড়ালাম। এই মায়ার জন্য সাড়ে তিন বছর ধরে নিজের প্রতি অন্যায় করে যাচ্ছি, আর না। 

“আমি তোমার কাছে অপরাধী? নিজের চেহারা দেখেছো আয়নায়? তোমাকে যে আমি বিয়ে করেছি তা তোমার সাত জন্মের ভাগ্য।” 
“দেখেছি ইমন। গত আটাশ বছর ধরেই আমি আমার চেহারার সাথে আছি। আমার চেহারার সাথে আমি খুব ভালো ভাবে পরিচিত। সেই জোরেই বলছি, সাত জন্মের ভাগ্য নয়, সাত জন্মের দুর্ভাগ্য।” 

ইমন লাফিয়ে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, “বেশি কথা শিখেছো দেখছি! আমি তোমাকে বলেছি কাজে যেতে পারবে না, এর অর্থ হচ্ছে পারবে না।” 

আমি আড়মোড়া ভাঙি। কোন কিছুই পাত্তা না দেয়ার সিদ্ধান্ত যেই মুহুর্তে নিয়েছি, সেই মুহুর্ত থেকে জীবন অনেক সহজ মনে হচ্ছে আমার কাছে। “কী করবে যদি কাজে যাই?” 

“বাসা থেকে বের করে দেবো।” ইমন বিজয়ীর হাসি দেয়। 

“ওহ, শুধু এই?” আমি মেকি হতাশার কণ্ঠে বলি। 

ইমন বিষ্মিত হয়। আগে আমাকে এই হুমকি দেয়ামাত্র আমি সবসময় কাঁদতে কাঁদতে নুয়ে পড়েছি। অনুনয় করেছি যেন এমন কাজ না করে যাতে আমার পরিবার কষ্ট পায়।

“আমি তোমার বাসায় ফোন করে বলবো যে তুমি বেয়াদব।”

আমি কাঁধ ঝাঁকাই, “বলতে পারো। আমি তাদের বাসার মেয়ে। তারা যদি আমার চেয়ে তোমার কথায় বেশি ভরসা রাখে, তবে এমন বাসার সাথে সম্পর্ক না রাখাই আমার জন্য উত্তম।” 

ইমন হুংকার দেয়, “তুমি ভাবছো আমি ফাজলামি করছি? সত্যি সত্যি ঘাড় ধরে বের করে দেবো বাসা থেকে।” 

আমি হেসে ফেলি, অনেকদিন পর ভেতর থেকে আনন্দে হাসি আসে আমার। “তোমার এত কষ্ট করতে হবে না ইমন। আমিই বের হয়ে যাচ্ছি।” বলেই আবার হেসে ফেলি। 

ইমন রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “এত হাসছো কেন? তোমার কাছে কি খুব মজার মনে হচ্ছে? তুমি জানো বাইরের পৃথিবী কেমন? একদিনও টিকবে না তুমি। জেনে রেখো, তুমি কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার পা ধরলেও আমি তোমাকে আর গ্রহণ করবো না।” 

আমি হাসতেই থাকি, “খুবই ভালো কথা। জেনে আসলেই শান্তি লাগলো। কারণ আসলে মনের কোণে একটু সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিলো যে আমি পারবো তো একা থাকতে? তুমি যে আর গ্রহণ করবে না জেনে স্বস্তি পেলাম। ফেরার পথ যখন নেই, তখন আর সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কী?” 

আমি একটা স্যুটকেস টেনে টেনে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। এই স্যুটকেস গত দেড় বছর ধরে প্রস্তুত ছিল। শুধু জানতাম না যে একদিন সত্যি সাহস করে বেরিয়ে যেতে পারবো ঘুণে ধরা সম্পর্কের বেড়াজাল ছিঁড়ে। গ্রীষ্মকালেও সিডনিতে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আমি আনন্দ নিয়ে আশেপাশের মানুষকে দেখি। মুগ্ধ নয়নে নৈরাশ্যজনক আকাশটাকে দেখি, আমার কল্পনার রঙে তা ছাইবর্ণ থেকে এক পলকে গাঢ় নীলবর্ণে রূপান্তরিত হয়। নিঃসঙ্গতার রোমান্টিকতা শাড়ির আঁচলের মত অঙ্গে জড়াই আমি। হাসিমুখে আমি পড়ন্ত বিকেলের সিডনিবাসীদের ভিড়ে হারাবার জন্য পা বাড়াই। আজ থেকে আমি শুধুই আমার।