ঊনমানুষের গল্প
প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:২৩
অন্ধকারেরও নিজস্ব আলো আছে। কিছুক্ষণ থাকলেই চোখ সয়ে যায়, চারপাশের সব দৃষ্টিগোচর হয়। গত এক ঘন্টায় ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে গেয়ে দোলাতে দোলাতে মেয়েটা এইমাত্র ঘুমালো। সেই যে মেয়েটা জন্মানোর ২৫ দিনের মাথায় চকিং এট্যাকে দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল এর পর থেকে ফিডিং করানো ও ঘুম পাড়ানোতে কত শত কসরত যে করতে হতো! সেই থেকে এই এক অভ্যাস হয়েছে। সবচেয়ে বিরক্তিকর হয়ে উঠে রাতে ঘুমপাড়ানো- তার ঘুম পাবে, মাথা নুয়ে আসবে কিন্তু সে কিছুতেই ঘুমাবে না খেলা করবে। সয়ে যাওয়া অন্ধকারে মশারি টাঙ্গাতে টাঙ্গাতে সাঁঝবাতির শরীর ক্লান্তিতে নুয়ে পড়তে চায়। কিন্তু না, তার বিছানায় যাওয়া চলবে না; তাকে হাঁটতে হবে টানা, শরীর মন একদম ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত সে হাঁটবে। একমাত্র বিরামহীন-বিশ্রামহীন হাঁটাই তাকে নিজের মধ্যে ধরে রাখতে সাহায্য করে। ভিতরের অভিমানগুলোকে দাবানল হতে দেবে না কিছুতেই, কিছুতেই বিষন্নতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে না সে, সমস্ত প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই সে ভালো থাকবে।
চুলগুলো দুইহাতে পেছনে নিয়ে রাবারে বেঁধে নেয় সে দ্রুত; তারপর চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ব্যাগটা ঝুলিয়ে রান্না ঘরে এসে দাঁড়ায়, সোমা তরকারী কুটছে।
- সোমা, তুমি কাটাকুটি করে সব ধুয়ে রেখো আমি এসে রান্না করবো, আর কিছু খেয়ে নিয়ো। বাবু ঘুমাচ্ছে, খেয়াল রেখো।
সোমা অবাক হয়ে বলে, "তুমি কই যাও এহন? তোমার তো শরীর খারাপ, অফিসে পড়ে গেলা অহন আবার বাইরইতাছ!"
- সমস্যা নেই তুমি বাবুর দিকে খেয়াল রেখো। আমার একটু কাজ আছে- বলে সাঁঝবাতি দ্রুত বেরিয়ে যায়।
বাসা থেকে নেমে গলিতে পা দিয়েই সাঁঝবাতি বুঝতে পারে আসলেই শরীরটা ঠিক নেই, কোমড়ের বাম পাশটায় চাপ চাপ ব্যাথা; তলপেটেও ব্যাথা হচ্ছে ঠিক যেমন পিরিয়ডের সময় হয়। দ্রুত সে ভেবে নেয় আজ কত তারিখ! না আরো পাঁচদিন বাকি আছে। তাহলে এই অস্বস্তিকর যন্ত্রণাটা হচ্ছে কেন? কয়েক মাস ধরেই ঝামেলা হচ্ছে; সঠিক সময় পিরিয়ড হলেও এক সপ্তাহেও শেষ হচ্ছে না। একটু হালকা সুতোর মত রয়েই যাচ্ছে। রাহাতকে বেশ কয়েকবার বলেছে সে; রাহাতও সাথে সাথে বলেছে, হুম! ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু পরে আর কারোরই মনে থাকছে না। নাহ, এবার ডাক্তার দেখাতেই হবে! সবকিছুতে ওর উপর নির্ভর করা কেন? শরীরটা যেহেতু তার, তাকেই মনে করে ডাক্তার দেখানো উচিত। দেখি কাল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিবো, ভেবে যেই সামনে পা বাড়িয়েছে হঠাৎ একটা কর্কশ হর্ন ওর ভাবনায় ছেদ ফেলে দিল।
- এই যে ম্যাম একটু দেখে হাঁটবেন তো না কি! গাড়ীর গ্লাস নামিয়ে ভদ্রলোক রাজ্যের বিরক্তি ঢেলে বললেন।
সাঁঝবাতি বলতে যাচ্ছিল ‘দুঃখিত’ কিন্তু তার দুঃখপ্রকাশ হাওয়ায় ভেসে ভদ্রলোকের কান পর্যন্ত পৌঁছুবার আগেই তিনি ফুস করে বেরিয়ে গেছেন। যাবেনই তো কার না সময়ের দাম আছে? পুঁজিবাদের এই যুগে সবার প্রতিমুহূর্তই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। কারো নাম মাত্র মূল্যে কারো বা চড়া মূল্যে। সন্ধ্যার বারান্দায় মুখোমুখি দুটো চায়ের কাপ নিয়ে বসার স্বপ্নদেখা প্রাণগুলোই ছুটছে নিজের একটুকরো বারান্দা পাবার আশায় অথচ সেই বারান্দাই পড়ে থাকছে পেছনে, শূন্য চায়ের পেয়ালা বুকে নিয়ে।
কালভার্ট রোড ও বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সিগনাল পার হয়ে সেগুনবাগিচায় ঢুকতেই নাকে চায়ের গন্ধ এসে লাগলো। রাস্তার ডানপাশের কোণায় চায়ের দোকান। হাত ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে নিল সে। সাড়ে আটটা বাজছে, এখনো বেশ জটলা- কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো তরুণ ও মাঝবয়েসি লোকই বেশি। ওরা কি সারা দিনের কাজ সেরে সংসারের তেল-নুনের হিসেবের গ্যাড়াকলে ঢুকবার আগে আর একবার মুক্তবাতাসে চা খেয়ে নিচ্ছে? সেও কি এক কাপ চা খাবে ওদের সাথে? একটু থমকে দাঁড়ালো সে কয়েক সেকেন্ড, না আরো হাঁটতে হবে আরো। একটু ধীর্ঘশ্বাস ফেলে সে এগিয়ে গেল। কেন এই দীর্ঘশ্বাস? বুক পকেটে খুব গোপনে জমে থাকা সন্ধ্যার চায়ের প্রলোভন, না এই টংয়ের চা’য়ের তীব্র গন্ধ, না দুটোই? সাঝঁবাতি হাঁটতে হাঁটতে শিল্পকলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, গেটের উল্টা পাশে চায়ের টংগুলো দেখে আবার বুকের মধ্যে জমে থাকা চায়ের তৃষ্ণাটা গলা পর্যন্ত উঠে আসবার আগেই সে নিজেকে শিল্পকলার ভেতর টেনে নিয়ে গেল। বেশ মানুষ মুক্তমঞ্চের চারপাশ ঘিরে। এই তারুণ্যের জটলা তাকে সবসময়ই মন্ত্রমুগ্ধের মত টানে। কোথাও জোড়ায় জোড়ায় কোথাও বা জোড়ার অধিক, আশা-স্বপ্ন-সম্ভাবনায় টগবগ করে ফুটছে, কোথাও আবার চুপচাপ পাশাপাশি বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা। মুক্তমঞ্চ, মাঠ, ক্যন্টিন পেরিয়ে সে হাঁটতেই থাকলো পুরো এলাকা ঘুরে। আবার প্রথম গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো হাঁটতে লাগলো সেগুনবাগিচা কাঁচা বাজারের দিকে।
রাস্তা পেরিয়ে বাজারের গলিতে ঢুকে একটু হাঁটতেই ‘এনজয় রেস্টুরেন্ট’ তার শরীরে ক্লান্তি এনে দিল যেন মনটাও এবার বিশ্রাম চাইছে। কিছু ভাবতে চাইল না আর সাঝঁবাতি, এনজয়ের দরজা খোলে হাতের ডানের প্রথম টেবিলে যন্ত্রের মত এগিয়ে গেল সে। নিজেকে ছেড়ে দিল সে- বহুল ব্যবহারে পরিচিত, আপনজনের মত চেয়ারটি তাকে কোলে লুফে নিল। ব্যাগ রেখে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস টেনে আবার ছেড়ে দিল বাতাসে। ফোনটা হাতে নিল সে, নাহ্ কেউ কল দেয় নি যদিও সে কারো কলই প্রত্যাশা করে নি। আপা অনেকদিন পরে এলেন, কি খাবেন? হাসি মুখে এনজয়ের কিশোর ছেলেটি এসে দাড়িয়েছে। সাঁঝবাতি মুখ তুলে হাসি ছড়িয়ে বলে তুমি কেমন আছ আবির? আমাকে চা খাওয়াতে পার? শুধু চা? আবির একটা ট্রেতে চা, আলাদা চিনি খুব ধীরে এনে টেবিলে রাখে। কিছুক্ষণ দাঁড়ায়, সাঁঝবাতিকে মোবাইলে ব্যস্ত দেখে আবার ধীরে চলে যায় কিন্তু লক্ষ্য রাখে দূর থেকে। সাঁঝবাতি মোবাইলটা হাতে নিয়ে অভ্যাসবসত ফেসবুকে ঢুকে স্ক্রল করতে থাকে। হঠাৎ নিউজফিডে চোখ আটকে যায়। সে ঠিক কী দেখছে! তার কেমন বমি পেতে থাকে, ছুটে যায় বেসিনের কাছে। পেটগুলানো তরল মুখ ছিটকে বেরুবার আগেই সে উপুড় হয় বেসিনে। একটু সময় নেয় তারপর চোখে মুখে পানি দিয়ে টেবিলের কাছে আসে। আপা আপনি কি অসুস্থ? আবির ভয় মিশ্রিত উৎকন্ঠায় জানতে চায়! কিন্তু কিছুই সাঁঝবাতির কানে যায় না। সে উদ্ভ্রান্তের মত টেবিলে চা’য়ের দাম রেখে ছুটে বেরিয়ে যায়। সে দ্রুত হাঁটতে থাকে, এক সময় ছুটতে থাকে বাসার দিকে। বাবা রেইপ করেছে দশ বছরের মেয়েকে! এক বার নয় বারবার। আর মিডিয়ার একের পর এক প্রশ্নের সামনে মা তার উত্তর দিচ্ছে! আবার সাঁঝবাতির বমি পায় রাস্তার পাশেই সে উপুড় হয়ে বসে পড়ে। দুই হাতে মুখ মুছে আবার দৌঁড়ায় সে। একটা রিক্সা নেবার কথাও তার মাথায় আসে না। সে দৌড়াতে থাকে, তাকে বাসায় পৌঁছুতে হবে এক্ষুনি।
তার ৩ বছরের মেয়ে ঘুমাচ্ছে আর রান্নাঘরে ১৬ বছরের সোমা তরকারি কুটছে, তাকে পৌঁছুতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। দুটো মেয়ে বাসায়, দুটো যোনীধারী ঊনমানুষ!
সাঁঝবাতি দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে.......। রাস্তার পুরুষ মানুষগুলো সব হা করে একটা ঊনমানুষের দৌড় দেখছে.....!