ছোটগল্প

তুচ্ছ কাজ

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২২:৫৩

ফাহমিদা খানম

"সারা সপ্তাহ পরে আসি, তাও তোমার ঘরের তুচ্ছ কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় লিরা? আমাকে সময় দেবার চেয়ে ঘরের কাজ তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?"
"রাগ পরে করো, নাও আলু পুরি আর চা খাও"

নাজমুলের কথা ১০০ ভাগ সত্যি। ও অন্য জেলা শহরে চাকুরী করে, বৃহস্পতিবার রাতে আসে, শনিবার বিকালবেলা চলে যায়। সপ্তাহান্তে এসে বউকে কাছে সে চাইতেই পারে কিন্তু সমস্যা হলো আমি গৃহিণীপনার মতো তুচ্ছ কাজে ব্যস্ত থাকি।

"সব কাজ আগেই কেন সেরে রাখতে পারো না তুমি? আমি বাসায় এলে শুধু আমাকেই সময় দিবে তুমি"

আমারো ইচ্ছে করে সব ফেলে ওর সাথে গল্প করি, সেটা আর বলা হয়ে উঠে না। কতো কথা জমে থাকে! পাশের রুম থেকে শ্বশুরের চিৎকার শুনে দৌড় দেই। বাবা বিছানায় প্রাকৃতিক কাজ সেরে ফেলেছেন, প্রায়ই এমন করে ফেলেন। ৫ বছর ধরে স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কোমরের নিচ থেকে অচল। উনাকে পরিষ্কার করে, নিজেও ফ্রেশ হয়ে রুমে যাবার আগেই ছোট মেয়ের চিৎকার শুনে দেবরের রুমে গিয়ে দেখি সেই পুরাতন ঝগড়া চাচা ভাতিজির। চাচা বলে তার মা সুপারমম ছিলেন, ভাতিজি বলে তার মা। এটা নিয়ে প্রায় খুনসুটি বাঁধে দুজনের। খাবার গরম করে টেবিলে দিলাম, ছোট মেয়েকে, বাবাকে খাইয়ে সব গুছিয়ে রুমে আসতে আসতে এগারোটার বেশিই বেজে গেলো।

"আমি আসলেই কি তোমার কাজ বেড়ে যায়?"
"গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত - সব ঋতুতেই সপ্তাহের ৭দিন আমার একই কাজ"

আমি হাসতে হাসতে উত্তর দিলেও নাজমুলের পছন্দ হয় না। মাঝেমধ্যে রুমে এসে দেখি বেচারা ঘুমিয়ে পড়ে।আহা বেচারা সারা সপ্তাহব্যাপী কঠিন খাটুনি খাটে, আমাদের জন্যই তো। আমিতো হাউজ ওয়াইফ - খুব তুচ্ছ কাজ সেটা।

ভোর পাঁচটায় উঠে নাস্তা বানিয়ে, ছয়টায় বড় মেয়েকে নিয়ে কোচিং যাই, বাসা থেকে কোচিং সেন্টার বেশ খানিকদূর বলে একা ছাড়ি না। ওকে দিয়ে বাসায় এসে ছোট মেয়েকে রেড়ি করে স্কুলে দিয়ে আসি- ৭:৩০ হলেই স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে যায়। রিক্সা দাঁড় করিয়ে রাখি, ফিরতে দেরী হলে বাবা খুব রেগে যায়, উনার খিদে পায়- বাসায় অন্য কেউ নেই। বাবাকে ফ্রেশ করে খাইয়ে নিজেও খেয়ে ফ্রিজ থেকে রান্নার সব বের করে ঘর গুছাই। দশটা বাজলেই আবারো বড় মেয়েকে আনতে যাই। ও বাসায় এসে খেয়ে রেডি হলে ওকে স্কুলে দিয়ে ফেরার সময় কাঁচা বাজার করে ছোট মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরি। বুয়াকে সময় দিয়েছি ১২:০০টায়। ছোট মেয়ে, বাবাকে গোসল করিয়ে রান্নাবাড়া করতে যাই। সবার খাওয়া সব গুছাতে গুছাতে ৩:০০টা বাজে। ৪:০০ টায় আবারো বড়টাকে আনতে যাই।

কতদিন কোথাও কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া হয়নি! নাজমুল এর আগে জামালপুর ছিল, হাতের কাজের থ্রিপিস আনতো মাঝেমধ্যে, খুব লোভ হতো ইস আমি যদি নিজে গিয়ে দেখে কিনতে পারতাম!

বাবাকে কার কাছে রেখে যাবো? এক ননদ লন্ডনবাসী, আরেকজন স্বামীর সাথে বগুড়ায়। মা নেই বলে নাকি আমিই ওদের ঠিকমতন আদরযত্ন করতে পারি না - ওরা খুব কম আসে। দেবরের উপর ভরসা করে বাবাকে রেখে কোথাও যাওয়া হয় না আমার। বয়স হয়ে গেছে বলে বাবার মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে, খাওয়া নিয়ে অনেক জ্বালায়। ভুনা,ভাজি আর গরুর মাংস খেতে চায় কিন্তু এসব হজম হয় না, খেলেই পেট ছেড়ে দেয়। নাজমুল, ননদেরা ফোন দিলেই বারবার বলে “যা মন চায় খাওয়াবে কিন্তু, কোনদিন আবার মরে যায়!”

বাবা প্রায় আমাকে বলে – "তোমার হাতের  রান্নাবান্না ভালো না বউমা, মুখেই তোলা যায় না"
বাবার কষ্ট আমি বুঝি, কতো আর এক রান্না মুখে রুচে? শিং, মাগুরের পাতলা ঝোল আর পেঁপে দিয়ে মুরগি।

শাশুড়ি মায়ের মৃত্যুর পর খুব একা হয়ে গেছেন। একাকীত্ব মানুষকে বদলে দেয়। এই মানুষটা আগে বাজারে যাবার আগেই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন কোন মাছের সাথে কোন সবজি ভালো লাগে। সময়ে সব বদলে গেছে, বিছানায় থেকে থেকে বাবা খিটখিটে হয়ে গেছেন।

ছুটির দিনগুলোতে নাজমুল বাসায় থাকে বলে ভালোমন্দ রান্না করতে চেষ্টা করি। প্রায় ও বলে - "এতো অল্প আইটেম করো কেন? মা আমাদের কতো কিছু রান্না করে খাওয়াতেন!"

আমার বলতে ইচ্ছা করে আমাদের মায়েরা বাচ্চাদের পিছনে এতো সময় দেয়নি, যুগ বদলেছে। কিন্তু বলি না তাতে হয়ত কথাই বাড়বে। একটা সবজি ভাজি, মাছ/মুরগি আর ডাল রান্না করি, শ্বশুরের রান্না আলাদা। বুয়ার শুধু দুই কাজ - ঘর মোছা আর জামাকাপড় ধোয়, বাকি সব আমাকেই করতে হয়। দুই মেয়ের পিছনেই লম্বা সময় চলে যায়। শুক্রবার নাজমুলের বাজার করার কথা থাকলেও প্রায় ঘুমের মাঝে উত্তর দেয় এই সপ্তাহ কষ্ট করে চালিয়ে নাও, পরের সপ্তাহে ঠিক করবো আর দেবর মাছ, সবজি চিনে না বলে বাজারটাও আমাকেই করতে হয়।

বড় আপু প্রায় ফোন দিয়ে বলে, "লিরা তুই যে এমন বদলে যাবি, আমরা কল্পনাও করিনি। কি জেদি আর ধারালো ছিলি তুই!"
"আপু ধারালো সত্ত্বাকে ঘষে ঘষে ভোঁতা বানিয়ে ফেলেছি, আমি এখন রঙ উঠা ঘষা পয়সা"

বিয়ের দুই বছরের মাথায় শাশুড়ি মারা গেলেন, ননদদের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, পুরো সংসার আমার কাঁধে। কিভাবে এখন দিন কাটে নিজেও জানি না।
নাজমুল এবার এসে এক কলিগের বউয়ের খুব প্রশংসা করেছে, কলেজে পড়ায়, সংসার করে, বাসায় নান্দনিকতার ছোঁয়া, গান পারে রান্নাবান্নাও নাকি অসাধারণ আর খুব পরিপাটি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করা সার্টিফিকেটকে খুব তুচ্ছ মনে হয় আমার। স্কুল এ কালচারাল প্রোগ্রামে আমি নিয়মিত ছিলাম। সব আজ অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি কেন সবার মতন সবকিছু পারি না! অক্ষমতার বোবাকান্না আমার ভিতরটাকে আছড়ে পিছড়ে মারে।

নাজমুলের ইচ্ছা আরেকবার বাবা হবার - ছেলের খুব শখ ওর, আমি রাজি হই না আবার যদি মেয়ে হয়! নাজমুলের জন্য কষ্ট হয় আমার কিন্তু কি করবো আমি? এই জীবনে কাউকেই খুশি করা হয়ে উঠেনি আমার।

ঠিক কতদিন, কতো বছর দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি আমার? নাজমুল চাকুরী সুত্রে বিভিন্ন জেলা শহরে বদলি হলেও আমার যাওয়া হয়ে উঠে না। সংসার, সন্তান আর দায়িত্বের ভিড়ে শিকড় দিন দিন বড়ই হচ্ছে, ইচ্ছেরা সেখানে বন্দী জালে।

পুরাতন সেই আমিকে আমি আর আমার মাঝে খুঁজি না, নিজের ধারালো সত্ত্বা ভোঁতা করে কবেই চুপ হয়ে গেছি তবুও বুকের মাঝে কে যেন প্রায় বলে উঠে- "গৃহিণীপনা আবার তেমন কোন বড় কাজ নাকি! তুচ্ছ কাজ!"

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত