ছোটগল্প: মনে থাকবে?
প্রকাশ | ১৮ জুন ২০১৮, ১১:৪৬
১.
খুব তাড়া ছিল তমার। এক হাতে ল্যাপটপের ব্যাগ, আরেক হাতে হ্যান্ডব্যাগ আর একটা ফাইল। ড্রাইভার বারবার ফোন করছে,
: ম্যাডাম গাড়ি রাখা যাইতেছে না, "সার্জেন" ধরতেছে, তাড়াতাড়ি নামেন।
তমা তাই অফিসের হাফ ডান কাজগুলো একরকম বগলদাবা করে বের হচ্ছিল। এই এক শহর। রাস্তার মধ্যে বিরাট বিরাট বিল্ডিং বানিয়ে রেখেছে অথচ গাড়ি রাখার জায়গা করা নেই। ওর গাড়িও অফিসে গাড়ি রাখার যে কয়টা জায়গা আছে তার মধ্যেই থাকে, আজ গাড়ি তানভীরের কাছে ছিল, তাই আর গ্যারেজে না রাখতে বলে সেই নামছিল। এর মধ্যে জরুরী একটা ফোন আসায় দেরী হলো। বের হতে রিসেপশন থেকে মেয়েটা একটা খাম এগিয়ে দেয়,
: ম্যাডাম আপনার একটা চিঠি এসেছে।
দুই হাতই আটকা। তমা খুব বিরক্ত হলো। বলল,
: শিল্পা কিছু মনে করো না আমার ব্যাগের চেইন খোলা জাস্ট একটু ব্যাগের মধ্যে ফেলো তো, পরে আমি দেখে নেবো।
শিল্পা তাই করে। গাড়িতে উঠে জিনিসপত্র রেখে একটু হাঁফ ছাড়ে তমা।
একটু গা এলিয়ে দেয়। এখন এক দেড়ঘন্টার জ্যাম পেরোতে হবে। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। ধানমন্ডি অফিস, বনানী বাসা। তানভীরকে কতবার বললো বাসা ধানমন্ডির দিকে নিতে। সে রাজি হয় না। তার অফিস গুলশান। সুবিধা হয়। একটা গান বাজছিল গাড়িতে, "মনে পড়ে সেই সুপারি গাছের সারি..."
প্রায় আধঘন্টা পরে চোখ খুলে দেখে মাত্রই ধানমন্ডি সাতাশ। বিরক্ত লাগে। হঠাত মনে পড়ে খামটার কথা। একটা গোলাপী রঙের খাম। ফেডেক্স এর ছাপ দেয়া। মানে বিদেশ থেকে এসেছে। উপরে স্পষ্ট করে নির্ভুল বানানে নাম লেখা ফারজানা ইসলাম। অফিসের ঠিকানাও। তমার ভালো নাম ফারজানা ইসলাম। সে দ্রুত হাতে খাম খোলে। বিদেশ থেকে এসেছে মানে জরুরী, কত ট্রেনিং ফ্রেনিং বা ইন্টারন্যাশনাল ইনভিটেশন আসে। তবে আজকাল তো মেইলই করে সবাই, চিঠি দেখে একটু অবাকও হয়।
খামের ভেতরে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ফ্লোরিডা থেকে এসেছে চিঠি। আবীর নামে কেউ একজন একটা কার্ড পাঠিয়েছে। একপাশে কবিতা লেখা।
পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু'জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক'রে দুচোখ ভ'রে থাকবো চেয়ে...
মনে থাকবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে? আমি হবো উড়নচন্ডি
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?
পরের জন্মে কবি হবো
তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।
তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে
নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে
গান বানিয়ে__
মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো...
মনে থাকবে?
আমার অনেক কথা ছিল এ জন্মে তা যায় না বলা
বুকে অনেক শব্দ ছিল__
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক
কাব্য করে বলা গেল না!
এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে
পরের জন্মে মানুষ হবো
তোমার ভালোবাসা পেলে
মানুষ হবোই__ মিলিয়ে নিও!
পরের জন্মে তোমায় নিয়ে...
বলতে ভীষণ লজ্জা করছে
ভীষণ ভীষণ লজ্জা করছে
পরের জন্মে তোমায় নিয়ে...
মনে থাকবে?
কবিতার আরেকপাশে একটা নোঙর আকৃতির লকেট দেয়া সরু চেইন। নোঙরটা হীরার।
তমা ঘামতে থাকে! আরণ্যক বসুর কবিতা পাঠিয়ে প্রেম নিবেদন। এই বয়সে! সে কি করবে বুঝতে পারে না। আবীর নামে ফ্লোরিডায় থাকা কাউকে সে মনে করতে পারে না। এরকম প্রেমের চিঠি! ভেতরটা ধুকপুক করতে থাকে তার। কে কে কে? কে হতে পারে? সে স্মৃতি হাতড়ায়। কলেজে পড়তে এক বন্ধু ছিল তার আবীর নামে। কিন্তু সে তো কোন আমলের কথা! আবীর তাকে একটুআধটু পছন্দ করতো। অমন পছন্দ তমাকে অনেকেই করতো। আবীরের মুখও এখন স্পষ্ট মনে নেই তার। আবীরেরও তার কথা মনে থাকার কোন কারণ নেই। তবুও ধ্বকধ্বক করা বুক নিয়ে সে রিয়াকে ফোন করে।
: রিয়া শোন তোর আবীরের কথা মনে আছে?
: কোন আবীর?
: আরে সোবহানবাগ কলোনীতে থাকতো, একটু ড্যাসিং টাইপ ছিল...
: ও হ্যাঁ শাফায়েত। হুম ডাক নাম আবীর। তো কি হইছে?
: ও কি ফ্লোরিডায় থাকে? তোর সাথে তো সবার খুব যোগাযোগ।
: না না শাফায়েত লন্ডন থাকে। কি হয়েছে বল তো?
বলবে না বলবে না করেও বলে দেয় তমা।
: শোন একটা চিঠি এসেছে আজ ফেডেক্সে, ফ্লোরিডা থেকে, একটা হিরার লকেটসহ চেইন... আর কবিতা লিখে পাঠিয়েছে। প্রেমের কবিতা।
রিয়া হেসে ফেলে।
: কবিতা আর শাফায়েত? ওর মধ্যে কবিতা বলতে কিছু আছে নাকি! তুইও যেমন। দ্যাখ আর কোন আশিক। খোঁজ নে। বাব্বাহ তোর ইনিংস তো বেশ লম্বা। এখনও প্রেমের চিঠি পাস। আমি তো রোজ একঘন্টা ট্রেডমিল করেও ফিট হতে পারতেছি না, মনির সারাটাক্ষন বডি শেমিং করে...
তমার কথাবার্তায় মন ছিল না। সে একটা "আচ্ছা দেখি কে" বলে ফোন রেখে দেয়।
২.
বাড়িতে এসেও অন্যমনস্ক থাকে তমা।
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে? আমি হবো উড়নচন্ডি
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?
এভাবে কে বলবে তারে? এতোদিন পরে? কেউ তার প্রেমে পড়েছে? সত্যিই? প্রেম যে এক অপরূপ ব্যাপার। কতদিন প্রেমে ডুবে থাকা হয়নি। কতদিন তীব্র কোন আশ্লেষ নেই। কেউ কি তাকে গোপনে ফলো করছে? তমা বেশ সুন্দরী। এই মধ্যবয়সেও সে ছিপের মতো টানটান, মেদহীন। প্রচুর বিউটিফিকেশনও করে। শরীরের কোথাও কোন স্ট্রেচমার্ক পড়তে দেয় না। তাকে দেখায় ২৫ বা ২৮। অফিসের কাজের ফাঁকে এই একটা জিনিসই সে মনোযোগ দিয়ে করে। সৌন্দর্যচর্চা। তানভীর রীতিমতো বিরক্ত হয়, বলে, তোমার তো রূপ বাতিকগ্রস্থতা আছে। সারাটাক্ষন এই মাখছো, সেই করছো, এত সৌন্দর্য ধুয়ে কি পানি খাবে?
তমা কিছু বলে না। দাঁতে দাঁত চেপে এইই করে যায় সে। কারোর চোখে প্রেম দেখতে চেয়ে। তানভীর তার রূপ বা মন কিছুই ভালোবাসেনি। সেটা নিয়ে কোন দুঃখও নেই তার। স্বামী-স্ত্রী একটা সামাজিক সম্পর্ক। সেখানে অত প্রেম খুঁজতে যাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই যে এতদিন ধরে এরকম লটকট রঙের ত্বক, পাতলা ঠোঁট আর বেতের মতো টানটান শরীর নিয়ে সে প্রেম কি বস্তু তা বুঝলো না, সেটা ভাবলে একটা জেদ চাপে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মক্ষেত্রে সবাই তমার রূপ ভালোবেসেছে, শরীরের প্র্রেমে পড়েছে- তমা বুঝেছে, কিন্তু কেউ কবিতা শোনায়নি, কেউ প্রেমে পড়েনি। প্রেম, প্রেম, প্রেম। কেউ একজন বলবে, তমা তোমাকে ছাড়া আমার চলে না, বলবে, তমা একদম নড়বে না চোখের সামনে থেকে, বলবে, তমা আর কারো দিকে তাকাবে না- এরকম প্রেমিক পুরুষ সে পায়নি। এইসব কথা তমা মনের ভেতর পুষে রাখে। তানভীর জানলে হিংস্রভাবে বলবে, প্রেমের কারবারী হতে চাইছো নাকি? তো আমাতে কোথায় কম পড়লো? তুমি সুন্দরী তো আমিও কি কম পুরুষ নাকি?
পৌরুষ আর প্রেমকে জগতের কোন পুরুষই আলাদা কেন করতে পারে না, সেটা খুব জানতে ইচ্ছা করে তমার। তাই সে ভুলেও এসব কথা বলে না তানভীরকে।
৩.
যাই হোক চিঠি রহস্যের কোন সমাধান হয় না। সারারাত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে সে। আবছা একটা অবয়ব। দেখে যে কেউ যেন সত্যিই তার কান্না শুষে নিচ্ছে। আধোঘুমে, তন্দ্রায় রাত কাটে। সকালে আজ একটু অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই সেজে অফিস যায় সে। প্রিয় রং তার লাল। লাল রং এর সামু সিল্কের শাড়ি পরে। যেন কবিতা পাঠানো চিঠি প্রেরক ফ্লোরিডা না ধানমন্ডিতেই তাকে দেখতে আসবে। কিরকম অদ্ভুত আনন্দ যে হয়। গোপন নিষিদ্ধ অথচ তীব্র আনন্দ।
অফিসে এ কাজ সে কাজের ফাঁকে বারবার চিঠিটার কথাই মনে হয়। বারবার চিঠি ছুঁয়ে দেখে। সন্তপর্নে উচ্চারন করে, আবীর আবীর আবীর...
বিকেল চারটার দিকে দরজায় টোকা পড়ে।
: ম্যাডাম আসবো?
সাব অর্ডিনেট এশা নক করে।
: এসো এশা। বলো কি ব্যাপার?
এশা একটু ইতস্তত করে।
: ম্যাডাম...
: বলো?
: ম্যাডাম কাল কি রিসেপসন থেকে শিল্পা একটা খাম দিয়েছে?
তমা ভয়ংকর চমকে ওঠে। এবং এক মুহূর্তে সব আবরণ সরে যায়। ফারজানা ইসলাম তো এশারও ভালো নাম। চিঠিটা আসলে এশার! নোঙরটা আসলে এশার! আবীর নামে কেউ একজন আসলে ২৫ বছরের এশার প্রেমিক। তমা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে খামটা এগিয়ে দেয়,
: স্যরি এশা। খামটা খুলে ফেলেছিলাম, বুঝিনি...
লজ্জ্বা লজ্জ্বা মুখ করে এশা খাম নিয়ে দ্রুত চলে যায়। তমা বসেই থাকে। হঠাৎ করেই লাল রঙের সামু সিল্ক শাড়ি অসম্ভব ভারী মনে হতে থাকে তার।