‘আমি বিশ্বাস করি নিজস্ব শক্তিতে’
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০১৮, ১৭:৫৬ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৮, ২১:০৪
ইলাস্ট্রেশন: চারু শিল্পী
‘সুন্দরের সঙ্গে বসবাস এবং ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’ শিরোনামে ২০০৫ সালের ১৬ জানুয়ারি তৎকালীন জনপ্রিয় দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ -এ বীরমাতা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পত্রিকার তৎকালীন প্রতিবেদক ইশরাত জাহান ঊর্মি। লড়াকু নারী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রয়াণে তার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ জাগরণীয়ার পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।
................................
ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কের বাড়িতে খুব বেশিদিন হয় নি এসেছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, এরই মধ্যে খোলা বারান্দা আর তার সামনের এক চিলতে জমিতে আবাদ হয়ে গেছে। শিল্পের আবাদ। পতিত জমিন কর্ষণ করে ফলিয়েছেন সোনা। শিল্পের সোনা। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এরকমই একজন। আবাদ করেন শিল্পের, পরিচর্যা করেন নিজের। ত্বক বা রূপের নয়, পরিচর্যা করেন অন্তরের, নিয়মিত পরিচর্যা দেন মানুষের সাথে সম্পর্কের। সেজন্যই নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে বহু আগে একসাথে কাজ করা সহকর্মী সকলেরই প্রিয় মানুষ তিনি, যেখানেই যান সকলে আঁকড়ে ধরে তাকে। ফেরদৌসী তাতে আনন্দিত, যদিও নিজে তিনি কোনদিন কোনকিছুকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়াননি। ‘৭১-এর বেদনা আর অহংকারকে বুকে পুষে প্রতিদিন শত তুচ্ছের প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে গড়েছেন ভাস্কর্য। ভাস্কর্য, শিল্পী এবং জীবন যোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সাক্ষাৎকারে নিজেকে মেলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইশরাত জাহান ঊর্মি।
................................
ইশরাত জাহান ঊর্মি: আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়ে গেছে, তারপরও নতুন প্রজন্মের জন্য নিজের ছোটবেলার কথা বলবেন কি?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: আমি খুব গর্ববোধ করি শিক্ষক পরিবারে জন্ম নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে বই পড়ার চল ছিল। অতি শৈশবেই জেনেছি, জীবনানন্দ দাশকে, বিষ্ণু দে'কে। সুকান্ত’র দেশাত্ববোধে আলোড়িত হয়েছি, শরৎচন্দ্র আর মহাশ্বেতা দেবীর বই পড়েছি। খুব ছোটবেলা থেকেই উপলব্ধি করেছি দেশপ্রেম, জেনেছি ভারতবর্ষকে। আমাদের সময় বার্গার খেতে হতো না, না চাইতেই নানারকম খেলনা পাওয়া যেতো না। নিজের খেলার উপকরণ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হতো। পুতুলই খেলতাম, কাপড় দিয়ে বানাতাম পুতুল। আর সেই তখন থেকেই খুব গুছিয়ে থাকতে পছন্দ করতাম। হয়তো পড়ার টেবিলের কালির দোয়াতটা রয়েছে ওটাকে একটু রাংতা দিয়ে মুড়ে নিলাম, কলমের ডগায় একটা ফুল বসালাম। কালির দোয়াতের সাথে রাংতা মোড়ানো খুব বড় কোনও শিল্প নয় বা এটা যে করতেই হবে- এমন নয়। কিন্তু ঐ যে যা আছে তাকেই আরও একটু সুন্দর করে নেওয়া- এই ব্যাপারটা ছিল। আমার বাবা খুলনা দৌলতপুর কলেজে শিক্ষকতা করতেন। খুব রাগী মানুষ ছিলেন, তবু আমাকে বলতেন এই মেয়েটা যেখানেই যায় সেই জায়গাটা কেন যেন সুন্দর হয়ে যায়। আমার ছোটবেলায় খুব বেশি উপভোগ করার মতো কিছুই পাইনি। অনেকগুলো ছোট ভাই বোন ছিল, ওদের যত্ন-আত্তি করতে করতেই সময় যেতো।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: আপনার সময়ের ছেলে মেয়েদের সাথে এই প্রজন্মের কি তফাৎ চোখে পড়ে?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: এখানকার ছেলে-মেয়েরা খুব ভালো ইংরেজি বলে, চলন-বলনে খুব স্মার্ট। একই সঙ্গে এরা খুব উদ্ধত। নম্রতা হারিয়ে গেছে। আমার তো মনে হয় প্রতিটি ইংরেজি স্কুলেই অ্যাটিচুড বা আচরণ শেখানোর জন্য একটা সেশন রাখা দরকার। কি করে বড়দের সাথে কথা বলতে হবে, কিভাবে মানুষকে সম্মান করতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে- এই সব সেখানো উচিত। ভালো ইংরেজি বলতে পারা আর ইংরেজি সাহিত্য বোঝা এক কথা নয়। আমি অনেক জায়গায় ইন্টারভিউ বোর্ডে থেকেছি। অভিজ্ঞতা হয়েছে, খুব ভালো একাডেমিক রেজাল্টের ছেলে-মেয়েরা উদ্ধত আচরণ বা ব্যাক্তিগত আচরণের ত্রুটির জন্য বাদ পড়ে গেছে। এই সময়ের ভীষণ ট্র্যাশ সংস্কৃতির ছেলে-মেয়েরা বাবা-মাকে এমনভাবে ট্রিট করে যে, ‘তোমরা তো কিছুই জানো না, আমি কত কি জানি!’ আবার নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়ে আছে যারা এসব থেকে একেবারেই মুক্ত।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: চারপাশে ছড়ানো এই সব ভাস্কর্য, তাদের জন্মদাত্রী হিসেবে আপনার অনুভূতি?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: আমি খুব কসরত করে একটা বিমূর্ত কিছু বানিয়ে তাকে ‘শিল্প’ নাম দিতে প্রস্তুত নই। আর্ট তো তাই যেখানে সহজেই মানুষের অন্তরে পৌঁছায়, তাই শিল্প। আর আমি তো কিছু তৈরি করি না, যা কিছু প্রকৃতিতে ইতিমধ্যেই আছে তারই কিছুটা পরিমার্জন করি। ধরা গেল এই টেবিলটায় কালির ছোপ লেগে গেল একটু। এটাকে রিমুভ করার চেষ্টা করবো না আমি, বরং এটাকে অপরিবর্তিত রেখেই কি করে আরেকটা শিল্পে রূপ দেওয়া যায়-তা নিয়ে চিন্তা করবো। প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়াল থেকে খুঁজে পাওয়া প্রাকৃতিক সামগ্রী যেমন গাছের গুঁড়ি, কাঠের টুকরো, নারকেলের ছোবড়া এ সবই আমার ব্যবহার্য। তবে এক্ষেত্রে আমি জোর দিই দেখার ভঙ্গির উপর। আরেকটা ব্যপার হলো, শিল্পের প্রধানতম শর্ত, ‘ভালো লাগা’। আমি লক্ষ্য রাখি শিল্পের এই শর্তটা পূরণ হচ্ছে কি না। কেউ গাছ কেটে ফেললে সেই কাটা গাছ থেকে নতুন কিছু উদ্ভাবন করার চিন্তা করি। কোনও কিছুই শেষ হয়ে যাবে, অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে এটা আমার পছন্দ নয়।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: এই যে বড় করে টিপ পড়া, হাতে ট্রাইবাল গহনা- আপনি অনেকের ফ্যাশন আইকন, ফ্যাশনটা কি সচেতনভাবেই চর্চা করেন?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: প্রশ্নই আসে না! আসলে হয়েছে কি, ওই যে একটু আগে বললাম না, কোন কিছুর অচলাবস্থাই আমার পছন্দ নয়, তার থেকেই এই ফ্যাশনের শুরু। ধরা গেল আমার খুব চমৎকার একটা শাড়ি আছে, মিলিয়ে কোনও ব্লাউজ নেই। এখন হয়তো ব্যস্ততার কারনে দু’মাস সময়ই পেলাম না ব্লাউজ মেলানোর, তো শাড়িটা কি পড়ে থাকবে? কনট্রাস্ট পড়া শুরু করলাম। দেখলাম খারাপ তো দেখাচ্ছে না, কফি রঙের সাথে লাল পাড়ের টাঙ্গাইলের ব্লাউজ! এভাবেই শুরু। আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। আগের যে বাড়িতে থাকতাম, উপরতলায় এক মেয়ের বিয়ে। শুনলাম ৭৫ হাজার টাকার গায়ে হলুদের শাড়ি এবং লাখের উপরে বিয়ের শাড়ি কেনা হয়েছে। আমার মনে হলো আমাকে দেখতে হবে- কী শাড়ি যা পরতে হয় এত পয়সা খরচ করে এই গরিব দেশে। গিয়ে দেখি পুঁতি দিয়ে কাজ করা বেনারসী ওজনদার শাড়ি যা পরলে গরমের দিনে একটা মেয়ে মরেই যাবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এরপর বিয়ে বাড়িতে আর ভারী শাড়ি পরিনি। যা আমি মুখে বলছি তা করেও তো দেখাতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান বললেন, ‘তাঁতের কাপড় পরুন, তাঁত শিল্পকে বাঁচান।’ তার পরনের কাপড়টি তাঁতের হয় তো? উপদেশ দিলে নিজেকেও প্রয়োগ করতে হয়। তাকে দেখতে আমাদের জনগণের নেতা মনে হয় তো? এইসব দিক চিন্তা করেই আমার ফ্যাশন। ফ্যাশন করবো বলে নয়, নিজের নিজস্বতা আর ঐতিহ্যকে বাঁচাতেই যা কিছু সাজসজ্জা।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: জীবনে হাজারো কঠিন পথ আপনি পাড়ি দিয়েছেন, সেই সব অবিজ্ঞতা কি ভাগ করবেন আমাদের সাথে?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: আমার কোন নিজের বাড়ি নেই। ভাড়া বাড়িতে থাকি। তা বলে হা-হুতাশ নেই কোনও। গড়ছি ভাস্কর্য যেখানেই থাকি। শ্বশুড়বাড়ি থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমি। আমাকে মেনে নেয়নি তারা। আমি দুঃখিত নই। একাত্তরের অভিজ্ঞতা আমাকে খাঁটি করে দিয়েছে। আমার তো মনে হয় না, পৃথিবীর কোনও নেগেটিভ কিছুই আমাকে ছুঁতে পারবে। ‘৭১-এর অভিজ্ঞতা প্রথম যখন আমি বর্ণনা করলাম, ‘আইন ও শালিস’ কেন্দ্রের শাহীন আক্তার, সুলতান কামাল- ওরা আমার ওপর কাজ করেছিল। আমাকে বলেছিল, ‘আপনি ভেবে-চিন্তে প্রকাশ করছেন তো সবকিছু? আপনার সংসার আছে, ছেলে-মেয়ে আছে’। রাজাকাররা তখন পার্লামেন্টে যাচ্ছে, আমি মুহুর্মুহু কষ্ট পাচ্ছি, গণআদালতে গ্রাম থেকে ‘৭১-এর নির্যাতিত নারীরা এসে সাক্ষ্য দিচ্ছে। আমি বললাম, ‘আমাকে বলতে হবে সেইসব কথা। আমার এই দায়িত্ব। আমার ছেলে-মেয়েরা যদি মেনে নিতে পারে মায়ের এই অতীতকে তো ভালো, না পারলে, আমাকে পছন্দ না করলে তাদের যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। আমার দায়িত্ব আমাকে পালন করতেই হবে।’ আমি হেরে যাইনি। ফলাফল কি হবে তা নিয়ে চিন্তা করিনি, লড়ে গেছি, এখনো লড়ে যাচ্ছি নিরন্তন।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: সম্প্রতি রিডার্স ডাইজেস্ট-এর ‘হিরো’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন আপনি, আপনার অনুভূতি?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: ১৯৯৬-এ ‘নারী ও ৭১’ এর কাজ শুরু হয় আইন-শালিস কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে। প্রথম প্রথম যখন সেইসব স্মৃতির কথা বলতাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। একবার এই দুঃসহ স্মৃতির মধ্যে ঢুকলে বের হয়ে আসা খুব কঠিন ছিল আমার জন্য। আগেই বলেছি কারো সাথে বাধা নয় আমার জীবন, আমি নিজেকে মেলে দিয়েছিলাম। ঘটনাটা দিনের আলোতে এনেছেন যারা তাদের সবার কাছে ঋণ আছে আমার, আমি কৃতজ্ঞ।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: কি করে কাটে সকাল থেকে সন্ধ্যা? অর্থাৎ আপনার জীবন-যাপন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: খুব ভোরে উঠে গান করি আমি। লোকে যেমন প্রার্থনা করে, আমি তেমন গান গাই ভোরবেলা। এতে শুদ্ধতা আসে ভেতরে। এরপর কিছু সময় চিঠি লিখি দূরে থাকা বন্ধুদের। এরপর রান্না করি। আমার নাতি প্রিয়দর্শন আমাদের সঙ্গে থাকে, ওকে তৈরি করে স্কুলে পাঠাই। বাড়ির অন্যদের খোঁজখবর নেই। তারপর আমার কাজে ডুবে যাই। এর মধ্যেই বাইরে কাজ থাকলে তা সেরে আসি। ভাগ করে নেই দিনটাকে, তাই সময় পেতে সমস্যা হয় না কোনও। আর উপভোগ করি একাকিত্ব। আমি অনেক সময় মানুষকেও বলতে শুনেছি, তারা একা থাকতে পারে না। আমি কিন্তু একা থাকার সময়ই বরং করে উঠতে পারি না। একা থাকতে পারলে আমি বেঁচে যাই। তখন গাছপালা দেখি, নিসর্গ দেখি, পাতার দিকে চেয়ে থাকি। সবকিছুই মেইনটেন করতে পারি আমি। একই দিনে মৃত্যু বাড়িতে যেমন যেতে পারি, জেলখানায় কারও সাথে দেখা করতে পারি, তেমনি বিয়ে বাড়িতেও। কোন বিয়োগই তো একসেপটেড নয়, কিন্তু মৃত্যুও তো খুব মহান। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘মরণরে তুঁহ মম শ্যাম সমান...’ একজন মানুষ মরে গেলে তার সম্পর্কে কেউ খারাপ কথা বলে না সে যদি খারাপ হয়েও থাকে। এভাবেই নানা আয়োজনে দিন কেটে যায় আমার।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: আপনার জীবনসঙ্গীর ভূমিকা জীবনে কতটুকু?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: আমি আমার হাজবেন্ডকে খুব ভালোবাসি, তিনিও আমাকে। তবে একথা বলতে পারি না, তার ভূমিকাই প্রধানতম আমার জীবনে। আমি ভালোবাসা পেয়েছি, তাকে যত্নে রাখবো, তার মানে এই নয় যে এই ভালোবাসা না পেলে মরে যেতাম আমি। নিজের শক্তি সবসময় নিজেকেই হতে হয়। আমার ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমি তাদের ডমিনেট করি না, তারাও আমাকে করে না। আমি বিশ্বাস করি নিজস্ব শক্তিতে। এই বিশ্বাস নিয়েই আমার নিত্য বসবাস।