ছোটগল্প: ঘর
প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:৪৯ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২০:৪৩
শ্রাবন্তী শেষবারের মতো ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। ঘরটাকে পেছন দিকে রেখে জানালার ফ্রেমের পাশে দেয়ালে পিঠ এলিয়ে; ঠিক যেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার ইট, বালি, ধুলো, রিকশার টুংটাং, স্কুল ফেরা কিশোরী কিংবা বাজার থেকে ফেরা লোকজনদের সে দেখে প্রায়ই। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। তার আগে ঠিক এই মুহুর্তটা শ্রাবন্তীর খুব প্রিয়। যখন আকাশটা গোলাপি, কমলা, ম্যাজেন্টা কিংবা আরো কি কি সব রঙ একসাথে মেখে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকে। যেন কোন ছোট্ট মেয়ে মায়ের দুপুরনিদ্রার সুযোগে ইচ্ছেমতন মায়ের সাজনবাটি দিয়ে সেজেছে।
পুরো বাসায় এই ব্যালকনিটাই শ্রাবন্তীর সবচেয়ে প্রিয়। কেন প্রিয়, সেটা আলাদা করে কখনো সে ভেবে দেখেনি। আজ হঠাত খুব মনোযোগ সহকারে তার এই প্রশ্নের উত্তরটা ভাবতে ইচ্ছে করছে। একটা কারণ হতে পারে এর আগে কোথাও শ্রাবন্তী এমন একটা খোলা ব্যালকনি পায়নি, যেখান থেকে ইচ্ছে হলেই হাঁড়িপাতিল-ওয়ালা-কে সুর করে ডাকতে দেখা যায়, চাইলেই ছুরি কাঁচি ধার দেয়া লোকটার ঐ মেশিনের চিরচির আওয়াজটা শুনা যায়, কিংবা ঐ যে ছেলেগুলো খেলতে বের হয় বিকেলে- ওদের আনন্দ কিংবা আক্ষেপের চিৎকারগুলো, মন্দ নয় তো। এমন তো আর দেখেনি শ্রাবন্তী। না, যে বাড়িতে তার বেড়ে উঠা বাবা মায়ের সাথে, সেখানে একটা টানা বারান্দা ছিল বটে। শ্রাবন্তী তার বাবার সাথে সেখানে পাল্লা দিয়ে হাঁটতো। দুজনেরই খুব হাঁটার অভ্যেস। কিন্তু একতলার বাড়ি, তার উপর চারপাশে ঝোপঝাড়, ফলে সেখান থেকে বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ টের পাওয়া গেলেও, অমন লাল-গোলাপি আঁচল ছড়ানো উপুড় হওয়া আকাশের দেখা মিলতো না। আকাশ দেখার জন্য তাই তার প্রিয় ছিল শ্যাওলা জমা ছাদটা। রক্তচন্দন আর কদম ফুলের ঘ্রাণে ভরা ছাদটায় বসে তাই সে নুয়ে পড়া আকাশ দেখতো।
কিন্তু নিলয়কে ভালোবেসে এই পোড়ার ঢাকা শহরে বাসা নিয়ে শ্রাবন্তী প্রথমবারের মতো জানতে পারলো এখানে অমন চাইলেই ছাদে যাওয়া যায় না। তাই ব্যালকনিই ভরসা। সেই যে ঢাকায় আসার পর প্রথম ফার্মগেটের বাসাটা! হ্যাঁ, সেখানেও একটা ব্যালকনি ছিল বটে, তবে সেই ব্যালকনি সমেত ঐ সমস্ত এক রুমের বাসাটা একটা জেলখানার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। চাতকের মতো সারাদিন চেয়ে থেকেও ও বাড়িতে এক চিলতে রোদের দেখা কোনদিন পায়নি শ্রাবন্তী। চারদিকের বিশাল বিশাল প্রাসাদগুলোর মাঝে জবুথবু হয়ে থাকা ঐ ঘরটায় বসে তার মনে হতো, কুমিরের পেটের ভেতরেও হয়তো এর চেয়ে বেশি আলো।
কিন্তু কিইবা করার ছিল শ্রাবন্তীর? সে তখনো পাশ করে বের হতে পারেনি। নিলয়েরও তখন ছোটোখাটো চাকরি। এই আগ্রাসী শহরে তখন টিকে থাকার জন্য অতখানির বেশি কিছু আর সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। হ্যাঁ চেষ্টা অবশ্য তারা করেছিল সেই চোরা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার। কিন্তু চেষ্টাটা ঠিক কাজে আসেনি। আবির ভাইদের সাথে শেয়ার করে একটা নতুন বাসায় উঠেছিল তারা। কিন্তু সেখানে আলোবাতাস খানিকটা জুটলেও ব্যালকনি ছিল না তার ভাগ্যে। সামনের করিডোরে দাঁড়িয়ে অমন ছটফটে কিশোর কিংবা ল্যামপোস্টের নিচে চুপিচুপি প্রেমপত্র বিনিময় অথবা শাড়ি-কাপড় বিক্রি করা ঐ মহিলা কিছুই দেখা যেতো না। সেখানে যতদূর চোখ যায় ক্লেদাক্ত পৃথিবী। কিন্তু সেই ক্লেদ জমা পৃথিবীর সামনেও অমন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো আর সম্ভব হয়ে উঠেনি শ্রাবন্তীর। আবির ভাইদের ছড়ানো সাম্রাজ্যের সামনে সবসময় নিজেদের দারিদ্র্যকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত শ্রাবন্তী তার ঘরের ভেতরটুকুকেই আপন করে নিয়েছিল। অবশ্য সেখানেও খুব বেশিদিন আর থাকা হয়নি তাদের। ঝামেলাটা লেগেই গেলো।
রুনু ভাবিই পরে একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। এমনিতে ওনার সাথে কখনই তেমন কথা না হলেও এবার বিপদে পড়ে একটা বাসার খোঁজে তাকেও নক দিতে হয়েছিল। সেই সূত্রে তিনিই পরে জানালেন পুরান ঢাকার ঐ ছোট্ট বাসাটার কথা। হ্যাঁ, পৃথিবী তার ক্লেদ জমা ফুসফুস নিয়ে সেখানেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ঠিকই। ট্যানারির নাক পচে আসা বিচ্ছিরি আবর্জনার সয়লাব পেরিয়ে তাদের পৌঁছুতে হতো বাসায়। ইটসোলিং করা খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে ৪ তলার উপর আরেকজনের ঘর পেরিয়ে ছোট্ট ঐ দুই রুমের বাসায় ঢুকতো তারা। ব্যালকনি ছিল না ঠিকই, কিন্তু দুটো ঘরের তিনটে জানালা যেন আলোবাতাস নিয়ে আসার সাথে সাথে বাইরের জগতের সাথে তাদের একটা মেলবন্ধনও করিয়ে রাখতো। রান্নাঘরটা ছিল শেয়ারে। অবশ্য বাথরুমটা আলাদা, সেটাই স্বস্তির ছিল শ্রাবন্তীর জন্য। ও বাড়িতে ছাদটা খোলা থাকলেও অমন ঘোর সাম্প্রদায়িক এলাকায় শ্রাবন্তীর ছোট চুল, টিশার্ট, জিন্স, টিপ- সবই খুব বেমানান ছিল। তাই পারতপক্ষে ছাদে যেতো না সে। তবু সবার সন্দিঘ্ন ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি উপেক্ষা করেই চেষ্টা করে যাচ্ছিল সে তেলাপোকার মতো টিকে থাকার। ততদিনে সে বুঝে গেছে, বেঁচে থাকার জন্য আগে টিকে থাকাটা জরুরি।
ততদিনে আস্তে আস্তে দিন ফিরেছে তাদের। দুজনেই তখন বেশ ভালো কিছু করছে। ঐ বাড়িতে ঝামেলা হবার আগেই তাই নিলয় তাকে নিয়ে এলো এখানে। যেদিন তারা উঠলো সেদিনই প্রথম বাসাটাকে দেখলো শ্রাবন্তী। সে কখনো ভাবেনি, এমন একটা বাসাও তার কখনো হবে! এখানে চারপাশ থেকে কেউ তার ঘরটাকে গিলে খাচ্ছে না, জানালার পাশে দাঁড়ালেই বমি উগড়ে আসা দুর্গন্ধ আর অশ্রাব্য গালিগালাজ ভেসে আসছে না। এখানে সব শান্ত, চুপচাপ। এখানে রিকশার টুংটাং, এখানে কিশোর কিশোরীদের উচ্ছাস, এখানে ছাদের উপর কতিপয় যুবকের হৈ-হুল্লোড়, এখানে পাশের ছাদ থেকে ভেসে আসা গানের আসর। আর ঐ ব্যালকনিটা, যেখানে চোখ মেললেই উপুড় হওয়া আকাশ, বিকেল হলেই যেখানে লাল-গোলাপি-কমলা খুকি, কোনো কোনো রাতে অ্যালুমিনিয়াম জোছনা, কোনো ভরদুপুরে যেখানে হাত বাড়ালেই বৃষ্টির স্পর্শ। সত্যি? সত্যি কখনো ঘর এতো সুন্দরও হয়? সত্যি কখনো ঘরে বসে থাকতেই এতো ভাল্লাগে?
প্রথমবারের মতো এই রাজ শহরের ভদ্রস্থ পাড়ার ঘরে উঠে শ্রাবন্তীর তাই আনন্দের সীমা রইলো না। যারা অমন করে কেবল একটা নিজের মতন ঘরের জন্য বছরের পর বছর হাহাকার করেনি, তাদের আসলে শ্রাবন্তী বুঝাতে পারছিল না- একটা ঘর, শুধু একটা ঘর, যেখানে সকালে রোদ আসে, বিকেলে হাওয়া বয়, যেখানে টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরলে তা নিয়ে জবুথবু হতে হয় না, যেখানে দেয়ালে চাইলেই নিজের মনমতো একটা ছবি ঝুলানো যায়, যেখানে ল্যাপটপে গান ছেড়ে হেডফোন না লাগিয়েই গান শোনা যায়, এমনকি চাইলে নিজেও গলা ছেড়ে গাওয়া যায়, যেখানে রান্নাঘরে রান্না করতে গেলে সদা ত্রস্ত থাকতে হয় না এই বুঝি কেউ এলো, যেখানে চাইলেই নিলয়কে জড়িয়ে চুমু খাওয়া যায়, যেখানে সারা ঘর ঘুরে ঘুরে দুজনে সিগারেট ফুঁকা যায়, যেখানে চাইলেই ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা যায়; না শ্রাবন্তী আসলেই বুঝাতে পারছিল না কাউকে- এমন একটা ঘর, একটা ঘর কেন, কিভাবে এতো অসাধারণ কিছু হয়ে উঠে জীবনে!
- শ্রাবণ!
- হুম...
নিলয়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে শ্রাবন্তীর। সে কখন এসে পেছনে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে কে জানে! সে কী এবারই প্রথম ডাকলো? নাকি এর আগেও ডেকেছে শ্রাবন্তী শুনতে পায়নি?
- কি করো এখানে? যেতে হবে তো
- না কিছু না, হ্যাঁ যাবো চলো
- হুম চলো, এমনি অনেক দেরি হয়ে গেছে। সন্ধ্যে হয়ে এলো
- হ্যাঁ আসলেই, সরি। চলো যাই।
নিলয় মেঝে থেকে তার ব্যাকপ্যাকটা তুলে নেয়। শ্রাবন্তীও তার ব্যাকপ্যাকটা। আসবাবপত্র যা কিছু সব এরই মধ্যে নিলয় পিকআপে তুলে দিয়ে এসেছে। শেষ মুহুর্তে দরকারি কিছু আর রয়ে গেলো কিনা সেটা দেখার জন্য আরেকবার পুরো ঘরে চোখ বুলায় শ্রাবন্তী। না কিছু নেই। শুধু স্মৃতিই রয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক। ৫ বছরের মধ্যে এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো ঘর বদলাতে হচ্ছে তাদের। তার মধ্যে এই বাসাতেই সবচেয়ে বেশিদিন থাকা হলো তাদের- দু' বছরের মতো। এক বছরের মধ্যে এসব নিয়ে কেউ কোন মাথা ঘামায়নি বলে শ্রাবন্তী আর নিলয় ধরেই নিয়েছিল আর হয়তো ঝামেলা হবে না। হয়তো ওরা এর আগে অমন কোন ভালো জায়গায় থাকেনি বলেই তারা জানে না। আসলে হয়তো অনেকেই এসব নিয়ে সেভাবে ভাবে না। এই বাড়িওয়ালা এর আগেও কিছুটা বুঝতে পেরেছিল হয়তো, কিন্তু ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণ করে দেয়ার পর থেকেই তার পরিবর্তনটা টের পাওয়া যায়, আর সেটারই সর্বশেষ পরিণতি এই বাসা ছাড়ার নোটিশ! শ্রাবন্তী আর নিলয়ের মতো আরো যারা আছে এই শহরে তারা সবাই তাদের বুঝিয়েছিল, অন্য কিছু লিখতে। কিন্তু কেন জানি তারা সত্যি কথাগুলোই লিখে দিল। আচ্ছা আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি, তাহলে মিথ্যে বলবো কেন? আমরা কি মানুষ না?
- শ্রাবণ, হলো তোমার? চলো
- হ্যাঁ...না...মানে... এমনি একটু দেখছিলাম, কিছু রয়ে গেলো কিনা
- না আর কিছু নেই। আমি দেখেছি ভালো করে। চলো তো। রিকশাটা দাঁড়িয়ে আছে কখন থেকে!
- হ্যাঁ চলো। আচ্ছা নিলয়... একটা কথা...
- আবার কি?
- মানে ধরো ওখানেও তো তারা ক'দিন পরে জানবে তখন যদি আবার ঝামেলা করে!
- সে জানলে জানবে। যদি ঝামেলা করে তো তখন দেখা যাবে। তবে চুক্তি অনুযায়ী দু' বছরের আগে কিছু বলতে পারবে না। তাই এখন এসব ভেবে লাভ নেই। চলো তো
নিলয় পা বাড়ায়। শ্রাবন্তীও। এই প্রাসাদ বোনা শহরে একজন নিলয় রহমান ও একজন শ্রাবন্তী ঘোষ এর একসাথে থাকার মতো ঘর এর বড্ড অভাব। কারণ এই সমাজে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, ঘুষ এর চেয়েও বড় অপরাধ ধর্ম না মেনে, ধর্মান্তরিত না করে, দুই ধর্মের মানুষের নিজ নিজ স্বত্ত্বা বজায় রেখে বিয়ে করে একসাথে ঘর করা। নিলয় আর শ্রাবন্তী এগিয়ে যায় নতুন কোনো ঘরের উদ্দেশ্যে। দরজাটা টেনে দেয়ার আগে শ্রাবন্তী শেষবারের মতো আকাশটার দিকে তাকায়। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। ঐ লাল-গোলাপি-কমলা আকাশটা আস্তে আস্তে ছেয়ে যাচ্ছে ছোপ ছোপ অন্ধকারে।