বেনামী গল্প
প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:০৫
মেয়েটি যখন সাড়া দিতে শিখলো, জানলো তার নাম 'কুড়ানি'। মেয়েটি যখন বাস করতে গেলো, দেখলো আবর্জনার পচা গন্ধে ভরে আছে তার বাসস্থান ফুটপাথ! মেয়েটি দেখলো তার মা সারাদিন কাগজ কুড়ায় আর বেচে। আর তার জট পড়া চুলে ভাঙা চিরুনি দিয়ে উকুন টেনে এনে গালাগালি দিতে দিতে পটাশ পটাশ করে নখে টিপে টিপে মারে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে! ক্রমশ মেয়ে বুঝে গেলো যখন তখন খেতে চাইলে থাপ্পড় খেতে হবে।
তো কুড়ানির এসব সয়ে নিয়ে বয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বারো বছর বয়েসে তার মনে হল মাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি তো আমার নাম কেন 'কুড়ানি'? ব্যাস্ এইখানেই বড় ভুল করে ফেলল সে। উত্তর এর বদলে এমন পেটালো তার মা যে পরদিন কুড়ানি পালালো আরেকটি প্রশ্ন ছেঁড়া নোংরা ফ্রকের মতো বুকে আগলে "আমার বাপের নাম কি?"।
কুড়ানি কোথায় পালিয়ে গেলো কেউ জানলো না। শুধু একটি ভাঙা আয়না যে তার সাথে গেলো, সে জানতো। কুড়ানি তার বুকে নিজের মুখ দেখে মনে মনে ভাবতো আমার একটা সুন্দর নাম দিতে পারলে না কেউ!
পারলো বইকি, কুড়ানি হারিয়ে যেতে পারলো, নিজের একটা নাম দিতে পারলো- 'রজনীগন্ধা' দশবছর পর! যখন তার ঠিকানা হাড়কাটা গলি। মাঝের দশটা বছর কোথায় কিভাবে হাত বেহাতের গল্প হয়ে ঠোঙা হয়ে গেল কে জানে!
যাক্ গে রজনী আপতত ঝালমুড়ির ঠোঙা থেকে উঠে আসা টক্ ঝাল গন্ধে খুশী! বেশ একটা ফুলের নাম নিয়ে মুখে রঙ মেখে ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে বেশ রাত কাটে তার। কত লোক আসে তার ঘরে! রজনীগন্ধা পান মশলা চিবিয়ে পিক ফেলে চলে যায়!
এভাবেই সুখে না হয় থাকতো রজনী, কিন্তু অসুখ করলো যে! কদিন ধরে গায়ে গতরে ব্যথা কাঁপিয়ে জ্বর এলো, আর এলো তো এলো এক্ ছোকরা ডাক্তার এক্ রজনীতে! চামেলি মাসি এ কাকে ডেকে আনলো? ডাক্তার যত চায় তাকে সারিয়ে তুলতে মেয়ে তত চায় অসুখে পড়ে থাকতে! এ কেমন মানুষ গো শুধু নারীর নাড়ি ছুঁয়ে চলে যায়!
না যায় না সে, ফিরে ফিরে আসে! আশার মতো! ওষুধে কাজ দিয়েছে তাহলে! ভুল, আবার ভুল করছে রজনী। এ ডাক্তার অন্য ধাতে গড়া। পাতে মেয়ে মানুষ পড়লেই চেটে খায় না!
চেটে খায় রজনী বমির ওষুধ। জ্বর ছেড়ে গিয়ে এ আরেক আপদ! ভারী বিপদ!
"অ্যাই ডাক্তার তোমার নাম কি গো?"
"বেজন্মা"- বলে হাহ্ করে তেরছা হাসে।
ছিটকে উঠে বসতে গিয়ে আবার বমি উঠে আসে রজনীর!
"ছ্যাঁকা খেয়ে লাভ নেই আমার মা এই গলিরই কোন একটা ঘরে জন্ম দিয়েছিল আমাকে। কবে যেন মরে যাবার আগে আমাকে লুকিয়ে পাচার করে দিয়ে ছিল অনাথ আশ্রমে। অনুদানে ডাক্তার বলতে পার।"
রজনী বমি আর চাপতে পারে না। ডাক্তার বলে কেউ আসছে! এদিকে মনে ঝড় আসছে- ওদিকে পেটে বাচ্চা! এ বলে 'ফেল' তো ও বলে 'ফেলে আয়'!
"ডাক্তারবাবু তুমি কি বল গো?"
"বাঁচিয়ে রাখ, ভদ্রলোকের প্রসাদ ফেলতে আছে?"
"না! জন্ম দেবো আমি, ও আমার! আমার রক্ত মজ্জা চুষে বড় হবে!"
বিদ্যুত্ এর আলোয় ঝলসে ওঠে রজনী!
"যদি মেয়ে হয় কি নাম দেবে?"
"আর যাই দিই 'কুড়ানি' দেবো না!"
"আর যদি আমি নাম দিই, যদি দিতে চাই ঠিকানা'- এক্ দৃষ্টে থাকিয়ে থাকে ডাক্তার।
সেই রাত্রে আবার পালায় রজনী। হয়তো কোন এক জন্মান্তরের দিকে। সঙ্গে এবার আর ভাঙা আয়না নয়, এক্ আস্ত দর্পণ ডাক্তার! রাতের ডাস্টবিন হাঁ করে ওদের পালাতে দেখে। কত বেজন্মার ঠিকানা কিনা রাতের ভাগাড়! ও জানে কার পাপের নাম-সরি-বাপের নাম কি। আপতত একটি অসম্ভব দৃশ্য দেখে ওকে খুশি হতে দিন।
কখন কে আবার কোন 'কুড়ানি'কে ঝপ্ করে ওর কোলে ফেলে যাবে তার ঠিক আছে?