ছোটগল্প: কলমিলতার নাকছাবি
প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৭
কলমিলতার মনটা আজ বেশ ফুরফুরে, বর্ষাকাল এলেই তার এমন হয়। ঘরে প্রতিদিন খাবার আসে। কারণ, তার স্বামী রাস্তা মেরামতের গ্রুপে খোদাইয়ের কাজ করে। আর এদেশে রাস্তা মেরামতের কাজ তো বর্ষাকালেই হয়। একদিক দিয়ে রাস্তা মেরামত করা হয়, অন্যদিক দিয়ে ভেঙে যায়। রাস্তা ভাঙলে পরের বছর আবার কাজ আসে। ওই যে তালতলা খাঁ বাড়ির সামনের রাস্তাটা, ওটা তো প্রতি বছরই ভাঙে। রাস্তার মাটি বর্ষার বানের স্রোত কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। ওখানে একটা কালভার্ট দিয়ে রাস্তা বাঁধলেই হয়তো জলের গতি কিছুটা স্বাভাবিক হতো, রাস্তাটাও আর ভাঙতো না। এটা কি চেয়ারম্যান নিজে বোঝে না? বোঝে, ঠিকাদারও বোঝে। কিন্তু…!
থাক, এই কিন্তু নিয়ে আর আলোচনা নাই বা করলাম এবার কলমিলতার কথায় আসা যাক। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেই গেছেন কলমিলতার মনে এতো প্রফুল্লতার কারণ। এখন বর্ষাকাল। আর তাই আকাশের মনটা আজ ভালো নেই। আকাশের এই মন খারাপ ব্যাপারটা কলমির ভারি পছন্দ। ওহ! বলা হয়নি, গ্রামের সবাই কলমিলতাকে কলমি বলে ডাকে। গতকাল সে বৃষ্টির জল ধরে রেখেছিল। আজ একটু সময় পেয়ে তাই দিয়ে সে তার নাকফুলটাকে বেশ ঘসেমেজে পরিষ্কার করছে। এই নাকফুলটা কলমির গর্ব। সেই ছোট বয়সে নাক ফোড়াবার সময় কে একজন বলে দিয়েছিল, মেয়েরা নাকফুল না পড়লে স্বামীর অকল্যাণ হয়। কথাটা তার মাথার মধ্যে মন্ত্রের মতো গেঁথে গেছে। তাই পরিবারে যত অনটন যত বিপদই আসুক না কেন, সে তার নাকফুলটাকে কখনো বিক্রি করেনি। এটা তার বিয়ের নাকফুল। শ্বশুর মশাই দিয়েছিলেন। পুরো একআনি সোনা আছে এতে। এ গ্রামে এতো বড় নাকফুল আর কারো নাই। বিয়ের পর থেকে সে একটা দিনও নাকফুল ছাড়া থাকেনি।
কলমি সারাদিন অপেক্ষায় থেকেছে, কখন তার স্বামী চান মিয়া বাজার নিয়ে আসবে। ঘরে চাল আছে আর আছে নুন-মরিচ। তাই দিয়েই দুপুরে মা-মেয়েতে ভাত খেয়েছে। মেয়ে পারুল শুধু নুন মরিচ দিয়ে খেতে চায়নি, বারবার মায়ের কানের কাছে খুনখুন করেছে, কিন্তু কলমি আদর দিয়ে ঠিক খাইয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘রাইতে দেখিস তোর বাপে মাছ আনবো নে, তহন মাছের মুরাডা তোরেই দিমুনি’। পারুল তাতেই খুশি হয়ে ভাত খেয়ে নিয়েছে।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। আকশে মেঘেদের ভিড়ে চাঁদ মধ্য আকাশে যখন উঁকি দিচ্ছে তখন চান মিয়াও ঢুলুঢুলু একজোড়া চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। ঠিকমতো দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছে না। অবস্থা দেখে কলমির চোখ কপালে। সে দেখেই বুঝতে পারলো তার স্বামী কোথা থেকে এসেছে। তাই আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘বাপে মাছ আনবো বইলা মাইয়া এহনো কিছু মুখে তুলে নাই, আর তুমি আইছো মদ গিল্যা, জুয়া খেইলা সব খোয়াইয়া সব্বনাস কইরা!’
কলমির কথায় হঠাৎ-ই চানের শরীরে অশরীরী শক্তি এসে ভর করে। ‘মাগি আমার টাকা আমি খোয়াইছি, তাতে তোর বাপের কি?’ বলেই কলমিকে টানা একটা চড় মেরে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর সেখান থেকে তুলে আবার মার। প্রায় আধা ঘন্টা বেধড়ক পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে।
কলমি সারারাত কেঁদেছে, মায়ের সাথে সাথে পারুলও কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোলা চোখ নিয়েই হাত-মুখ ধুতে কলমি চলে গেল পুকুরঘাটে। পাশের বাড়ির বকুলের মা কলমিকে বলল, ‘কাইল নাকি চান তোরে খুব পিটাইছে?’ কলমি কোন উত্তর করলো না।
কুলের মা আবার বলল, ‘তোর কাপড়ের অবস্থাতো এক্কেরে বেহাল, এবার ওই নাকছাবিটা বেইচ্চা একটা শাড়ি কিন। তোর দুইখান কাপড়ই তো ছিইড়্যা গেছে। আষাঢ় মাস তো যায় যায়, চান তোরে একটা কাপড়ও কিন্ন্যা দিলো না! অইডা বেচলে একটা শইস্যাদানা নতুন নাকছাবিও পাবি আবার একটা শাড়িও পাবি।‘
কলমি সাথে সাথে বলে উঠলো, ‘আমার নাকছাবি দেখলে তোমাগো এতো হিংসা লাগে ক্যান? নাকছাবি পরি পারুলের বাপের মঙ্গলের লিগ্যা, ভাত কাপড়ের লিগ্যা না।’