আনারকলিরা

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:০৬

শীতের বিকেলে বেশ আয়েশ করে চা-এ চুমুক দিচ্ছিল ঐন্দ্রিলা, ঠিক এমন সময় তার বাংলোর দারোয়ান এসে জানাল - 
ম্যাডাম, একজন মহিলা আসছে যশোর থেকে, আপনার সাথে দেখা করতে চায়। 
- মহিলা! যশোর থেকে এসেছে? আমার সাথে দেখা করতে চায়, কেন? 
- উনি বলতাছেন উনি নাকি বরিশাল-বরগুণা সাইটে কাজ করে সেলিমের স্ত্রী। 
- কোন সাইটে? 
- বরিশাল-বরগুণা।

ঐন্দ্রিলা যখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয় তখনই তার বাবা বলেছিলেন, ‘মাইগ্রেশন করে আর্কিটেক্ট ডিপার্টমেণ্টে যাও। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং মেয়েদের জন্য না। এরপর সরকারি চাকরি করতে গেলে সরকারি দলের টেন্ডারবাজ আর ক্যাডারদের হুমকি ধামকি আর চোখ রাঙানিতেই দিন যাবে। লাইফ রিস্ক তো বাদ দিলাম।’ 

কিন্তু গতানুগতিকতার বাইরেই তার ঝোঁক। তাই বাবার কথা উপেক্ষা করল সে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ল। তবে সরকারি চাকরীতে না ঢুকে গেল এনজিওতে। একটা আন্তর্জাতিক লেবার বেনিফিট অর্গানাইজেশনে কাজ করে সে। যদিও সে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা তাই শ্রমিকদের সমস্যাগুলো নিয়ে তাকে সরাসরি ডিল করতে হয় না। তারপরও ঝক্কি ঝামেলা যে পোহাতে হয় না তা না। মাঝে মাঝেই শ্রমজীবিদের সাথে তার আলাপ আলোচনা হয় এবং সে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক সমস্যার সমাধানও করে থাকে। অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা জমে তার ঝুলিতে। যা তাকে মানুষ ও জীবন সম্পর্কে জানতে শেখায়। তবে আজ তার মুডটা একটুও ভালো ছিল না, তার ওপর একি উটকো ঝামেলা!  স্বভাবতই একটু বিরক্ত হলো সে। সাইটের লেবারের স্ত্রী, সে তার কাছে কি বলতে এসেছে? তাদের সংস্থার বা ঠিকাদারের এখানে বড় অফিস আছে, তাদের কাছে যাক। এটাই বলা স্বাভাবিক ছিল তারপরও কি ভেবে দারোয়ানকে বলল, বারান্দায় বসতে বল। আচ্ছা - কার স্ত্রী বললে? 
দারোয়ান চলে যাচ্ছিল ঘুরে বলল, সেলিমের। 
সেলিমটা কে? আমি কি চিনি? 
দারোয়ান মাথা চুলকে বলল, ঐ যে লেবারগো সরদার।

‘সরদার’ বলায় ঐন্দ্রিলা এবার লোকটাকে চিনতে পারল। কারণ প্রায় দু’বছর হতে চলল সে মাঝে মাঝেই ঐ সাইট পরিদর্শনে যায়। এবং ওখানকার লেবারদের টিম লিডার সেলিমের সাথে কয়েকবার কথাও হয়েছে তার। লেবারদের সুযোগ সুবিধা দেখা ব্যক্তিগতভাবে তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, তারপরও ওদের বকেয়া পাওনা গণ্ডা বিষয়ে সুরাহা পাবার জন্য মাঝে মাঝে তাদের সংস্থার শরণাপন্ন হয়। যেহেতু বিল গভর্ণমেণ্ট ডিপার্টমেণ্টের হাতে থাকে, হয়তো কোনো দাতা সংস্থার প্রজেক্টের অধীনে। তাই তাদের কথার গুরুত্ব থাকে বৈকি! আর একবার দেখা হলে বা কথা হলেই ঐন্দ্রিলা যেকোনো লোককে মনে রাখতে পারে। এমন একটা দোষ বা গুণ তার মধ্যে আছে। যদিও তার মতো অফিসারদের খুব সাধারণ মানুষদের ভুলে যাওয়াটাই নিয়ম। কিন্তু তার মনের কোন এক কোণে এরা থেকেই যায়। এই সেলিমের স্ত্রীকেও সে দেখেছে। সেও ঐ রাস্তায় কাজ করা মহিলা শ্রমিকদের একজন। মেদহীন শক্ত সমর্থ চেহারা, বয়স ২৭/২৮ এর মধ্যে, সারাদিন রোদে পুড়ে রাস্তা-বাঁধ নির্মাণের কাজ করলেও তার চূড়ো করে বাঁধা চুল, পেচিয়ে পরা শাড়ি ও শাড়ি ওপরে শার্ট পরিহিতা এই নারীর মুখে লাবণ্য এখনো হারায়নি। তাকে দেখলে মাঝে মাঝে খাজুরাহো মন্দিরের গায়ে খোদাই করা উদ্ভিন্ন যৌবনা সেই প্রাচীন নারীদের কথা মনে পড়ে যায়।

চা শেষ করে বারান্দার দিকে যেতেই ঐন্দ্রিলার একটু খটকা লাগলো। দীর্ঘ বারান্দার এককোণে ফর্সা-রঙ রোদেপুড়ে তামাটে হয়ে আসা লম্বা ছিপছিপে গড়নের যে মহিলা বসে আছে সে মোটেই তার চেনা সেলিমের স্ত্রী ‘বিজলি’ নয়। এ যে অন্য কেউ!

দারোয়ানকে ডেকে একটা ধমক দিল। ওকে ধমক দেয়ার ইচ্ছা তার অনেকদিন থেকেই ছিল, কিন্তু কোনো স্পেসিফিক রিজন পাচ্ছিল না। এই হাম্বাকটা সারাদিনই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে থাকে। সে যে শুধু বাড়ির লোকদের সাথেই হাসে তাই না, সে বাইরের রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া পথচারিদের সাথেও হেসে হেসে আলাপ জুড়ে দেয়। এহেন দারোয়ানের কাছে বাড়ি-ঘর নিরাপদ না। ঐন্দ্রিলা রাগী ভঙ্গিতে বলল, এ তো বিজলি না, এ কে? কি বলতে এসেছে এই মহিলা? দারোয়ান আবারো হেসে বলল, ম্যাডাম উনি সেলিমের প্রথম পক্ষ। আমরা জানতাম না, উনি বলতাছেন। 
ঘটনা কেমন যেন রহস্যজনক মনে হলো ঐন্দ্রিলার কাছে। 
অতঃপর ঐ মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল চিরচরিত সেই একই কাহিনী। তার তিনটে ছেলে মেয়ে আছে, বাড়িতে বৃদ্ধ শ্বশুর আছে অথচ প্রায় দেড় বছর ধরে তার স্বামী বাড়িতে যায় না। তাদের কোনো খোঁজ খবরও নেয় না। এখানে নাকি টাকা পাওনা আছে ঠিকাদারের কাছে। 
- ম্যাডাম যদি একটু ওনাদেরকে বইলা দিতেন! 
- তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে, তোমার স্বামী? 
- জ্বি। 
- কিন্তু ওটাতো আমার কাজ না, ঠিক আছে আমি বলে দেব, কাল ওদের সাথে তোমার স্বামীকে দেখা করতে বলো। আর সেলিম বাড়ি যাবে কি, তার তো এখানে বৌ আছে দেখলাম। 
মহিলার তার স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস। সে ঐন্দ্রিলাকে অবাক করে দিয়ে বলল, না আপা, বৌ নাই। ঐটা সবার বোঝার ভুল। 
- বোঝার ভুল মানে? 
মহিলা খুব বিনয়ের সাথে বলল, মাইনে হইল আপা, লেবাররা সবাই এক সাথে থাকেতো মহিলা-পুরুষ পাশাপাশি ঘর, কখনো একই ঘরেও থাকে, তাই ওরা ওই রকমই থাকে। এজন্য সবাই ভাবে স্বামী-স্ত্রী। 
- কিন্তু.., আপনার নাম কি? 
- জ্বি জয়নব। 
- শোনেন জয়নব, ওখানে তো আরো লেবার থাকে মহিলা এবং পুরুষ, কই তারাতো কেউ নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয় না! তুমি ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখ। 
জয়নব তেমনি বিনয়ে বলল, জ্বি আচ্ছা। তবে গলার স্বরে একটা অবিশ্বাসের সুর লেগে রইল। 
ঘরে ফিরতে ফিরতে এখনো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া ঐন্দ্রিলা ভাবল, কি ভেবে মহিলা এ কথা বলল? বোকা নারী! পুরুষে এতো বিশ্বাস সে পেল কোথায়? 


ম্যাডামের কথা শুনে জয়নবের মনের ভেতরে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাতিটাও নিভে গেল দপ করে। পাছে স্বামীর কোনো ক্ষতি হয় এই ভেবে সে এ কথা সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নাই। তবে এ কথা তাকে মতিন বার বার জানিয়েছে। মতিনকে সে বিশ্বাস করতে পারে নাই তাই তার মনে একটা আশার প্রদীপ টিম টিম করে জ্বলত সারাক্ষণ। হয়তো মতিনের কথা মিথ্যা। সে তাকে তার ঘরের বৌ করতে চায় তাই হয়তো কোনো ষড়যন্ত্র করতেছে শয়তানটা। সেলিমের সাথে বিয়ে হবার আগেই মতিন জয়নবের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেলিমের সাথে তার ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক সেখানে সে মতিনের বিয়েতে রাজি হবে কোন দুঃখে। তারপর মতিনও অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে কিন্তু জয়নবকে সে ভুলতে পারে নাই। 
এইবার সেই যে মানুষটা দুই মাসের কথা বইলে গেল আর তার কোনো খোঁজ নাই। ঘরে বৃদ্ধ শশুরের দেখভাল করে, তিন তিনটে ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে তারপর সারাদিন সেলাইএর কাজ করেও জয়নবের সময় যেন আর কাটে না। বড় দীর্ঘ মনে হয় দিনগুলোকে। কিসের এক একাকীত্ব কুরে কুরে খায় তাকে। জয়নবের সব সময়ই একথা মনে হয় যে, তার স্বামী যদি সত্যিই আর একটা বিয়ে করে থাকে তাহলে সে আর তাকে এখন ভালোবাসে না। তার প্রতি তার স্বামীর সব ভালোবাসা উবে গেছে। তার নতুন বৌ-ই এখন তার সব। কিন্তু এসব জানার পরও জয়নব এখনো তার স্বামীকে ভালোবাসে। অথচ ঐ লোকটাকে এখন তার ঘেন্না করা উচিৎ, অথচ জয়নব পারে না। সেই উথাল পাথাল ভালোবাসার দিনগুলোকে সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। মাঝে মাঝেই বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। শুন্য মনে হয় সবকিছু। কিন্তু এমন তো হবার কথা না। দীর্ঘদিন এই মানুষটা তাদের কোনো খোঁজ খবর করে না। আগে ফোন টোন করতো পাড়ার মোবাইলের ফোনের দোকানে, এখন তাও করে না। বাড়ি টাকা পয়সাও পাঠায় না। শ্বশুরের ঐ বিঘে দুই জমিন ছিল বলে, নইলে তো এতদিনে না খেয়ে মরা লাগতো। তারপরও জমিতে ধান যা হয় বছর খোরাকি হয় না। সদাই-পাতি তো জয়নবের সেলাইএর উপার্জনেই চলে। তারপরও রোগ শোক হলে ওষুধ-পত্তি জোটে না। ছেলে মেয়েদের জিজ্ঞাসা, অভাবের সংসার টেনে নিয়ে যাবার শত যন্ত্রণার ওপরে স্বামী মানুষটার তার প্রতি এই অবহেলা জয়নবকে ভীষণভাবে বিদ্ধ করে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় যেন সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যায়! ও পাড়ার মতিন তো তার জন্য দ্বার খুলে বসে আছে। ভাবে সাবে সে প্রায়ই জয়নবকে জানায় সে কথা।
- কি লাভ আর ঐ বেটার সংসার আইগলে রোইখে। এইতো সেদিনও দেইখে আসলাম সে নতুন বৌ নিয়ে মহা মৌজ এ আছে। প্রতিশোধ নিতে মন চায় না? প্রতিশোধ! যারে এতো ভালোবাসলা সে এখন অন্য মাইয়া মানুষের আঁচলের তলে..। চলো আমার সাথে জয়নব, রাণীর মতো রাখবানে তোমারে। 
খিচিয়ে ওঠে জয়নব, প্রতিশোধ নিতে হইলে আদালতে যাবানি, তোমার সাথে ক্যান? 
জয়নব পারে না। চাইলেই পারে না ছেলে মেয়েদের এভাবে ফেলে রেখে আদালতে যেতে বা কোথাও কারো সাথে চলে যেতে পারবে না সে। আর ঐ মতিন একটা সাক্ষাত শয়তান। তারপরও তার কথা যে মিথ্যা এটা ধরে নিতেও পারেনা সে। এমন ধরার কোনো কারণও নেই। মতিন আর তার স্বামীতো একই কাজ করে। এই যশোর থেকে শ্রমিক জোগাড় করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে নিয়ে যায়। সে বারবার ফিরে আসতেছে বাড়িতে কিন্তু তার স্বামী কেন আসে না এবার! ধীরে ধীরে আশঙ্কা গাঢ় হয় তার। তারপরও জয়নবের মনের মধ্যে একটা কাঁটা সব সময় বিধে থাকে যে, সেলিমের মতো কেউ তারে ভালোবাসা দিতে পারবে না। লোকটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই কিন্তু তার মতো আদর সোহাগ করতে পারবে কে! জয়নব যা পেয়েছে তাই নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়। সেবার যখন পুকুর ঘাটে পিছলে পড়ে পা মচকে গিয়েছিল জয়নবের, মানুষটা তার জন্য কী না করল। তাকে তো নড়তেই দিত না। তার ওপরে রাতের বেলা পা-এ তেল মালিশ করতো সে। তারপরও মাঝে মধ্যে মনে হয় লোকটা যদি এর চেয়ে মরে যেত তাহলে বোধ হয় তার কষ্টটা একটু কম হতো। অন্তত অপমানের জ্বালাটা থাকতো না। 
জয়নব কিছু কিছু ধর্মের কথাও শুনেছে, মুসলমানের ছেলে কাজের উছিলায় দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকলে ‘মোতা’ বিয়ের একটা নিয়ম আছে। দিনের পর দিন পইড়া থাকে কামের জায়গায়, সেই উছিলায় যদি..! হায়রে ধর্ম! জয়নবের চোখ বেয়ে নামে জলের ধারা। অপমানের, বিষাদের।

৩ 
সেলিম দেখতে সুপুরুষ, তার গায়ের রঙ ফর্সা, লম্বা ও গড়পড়তা পুরুষের তুলনায় বেশি। ইদানিং সে মুখে চাপ দাড়ি রেখেছে তাতে তার চেহারায় আরো খোলতাই হয়েছে। তবে মনুষটার মনে বোধ হয় কি এক অশান্তি দেখা দিয়েছে আজ কাল। দুপুর বেলা গোসল করতে গিয়ে বিষয়টা নজরে পড়ল গোপালের। গোপাল হলো সেলিমের সাগরেদ। আজকে রাস্তায় কাজ বন্ধ। তাই সবাই যে যার মতো গোসল করতে যাচ্ছিল কালীবাড়ি পুকুর ঘাটে। এইখানে আসার পর থেকে তারা এই পুকুরেই তাদের কাজ কর্ম সারে। নাওয়া খাওয়ার জল ইত্যাদি। গোপাল পুকুরে যাওয়ার আগে ঝোপের আড়ালে জল বিয়োগ করতে বসেছে এমন সময় পাতার ফাঁক গলিয়ে দেখল পুকুর ঘাটে উল্টোদিকে মুখ করে বসে আছে সেলিম ভাই। মাথাটা পানির দিকে সামান্য ঝুকে আছে। একটু পরপরই কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। এই ঘোর গরমে কাঁপতিছে কেন লোকটা! না-কি কাঁনতিছে! সেলিমের কান্নার কারণটা এই মুহূর্তে ধরতে পারে না গোপাল। কারো সাথে কাইজা ফ্যাসাদ তো লাগি নেই, তালি কি বিজলির লগে কোনো ঝগড়া লাগছে তার! 
গোপাল দ্রুত পদে এগিয়ে যায় সেদিকে। ধীরে ধীরে ওস্তাদের বাহুতে হাত রাখে সে। 
কি হইছে ভাই? হইছে কি, কোনো সমস্যা? 
তুই জানস না? আবার জিগায়! হাত দিয়ে এক ঝটকা মারে সেলিম। 
গোপাল আসলেই জানে না, তার বরং ধারণা ছিল ওস্তাদ বেশ সুখেই আছে। কারণ এখানে কাম করতে আইসে এবার সে বিজলিবানু নামের এক কামলা মহিলারে বিয়ে কইরে ফেলিছে। সারাদিন রাস্তা নির্মাণের কঠিন পরিশ্রমের পর তারা যখন ছাপড়া ঘরে উপোসী রাত কাটায় তখন ওস্তাদ তার নতুন বৌ নিয়ে মৌজ করে। সেই ওস্তাদের মনেও যে কোনো দুঃখ থাকতে পারে যার জন্যে সে ঘাটে বসে কাঁনতে পারে এটা তার মাথাতেই আসে নাই। গোপাল কেবল বুঝতে পারে তাদের যাবার সময় হয়ে এসেছে আর মাত্র দিন পনেরোর কাজ বাকি আছে। কিন্তু ওস্তাদ এখন কান্দে কেন? তাইলে কি বিজলিবানুর জন্য; তারে নিয়ে বাড়ি যাতি পারবে না তাই! 
সেলিমের দেশে ফেরার জন্য মন পোড়ে। ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য মন কেমন করে তার। কিন্তু বিজলিরে সে কিছুতেই মানাতে পারেনা। একদিকে বিজলি অন্যদিকে মতিন। মতিনের যন্ত্রণায়ও সে দেশে যাতি পারতিছে না। তার কাছে এখনো আগের খ্যাপের ১৩ জন লেবার টাকা পায়। রাস্তায় সিলকোড করতে এসেছিল এরা। তাও কম না ৩৬ হাজার টাকা। এই টাকা পরিশোধ না কইরে বাড়ি ফিরলি এরা তারে খাইয়ে ফেলবে! ভিটের মাটিও তুলে ফেলবেনে। সে কথা ঠিকাদারি ফার্মের ম্যানেজারকে জানালে সে যা বলল তাতে সেলিমের মাথায় বাজ পড়ার দশা। 
ম্যানেজার একদিন খাতা পত্র ঘেটে বলল, টাকা তো মতিন প্রায় সবটাই এ্যাডভান্স নিয়ে গেছে, কই তোমাকে দেয় নাই? তাহলে তোমার লোক আসলো কি করে? 
স্যার তাগেরতো আমি নাম মাত্র কিছু আগাম দিয়ে আনিছি - এই হাজার বিশেক। মাঝখানে একবার পেমেণ্ট হইছিল কিন্তু তারা যে এখনো ৩৬ হাজার টাকা পায় আমার কাছে! 
ম্যানেজার বলল, দেখো সেলিম এটা তোমার আর মতিনের ব্যাপার তোমরাই মিটমাট করে নাও। আমাদের জ্বালাতন করবা না।
সে ম্যানেজারের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে নাই। তাই সে একদিন অফিসার ম্যাডামের কাছে যায়। ম্যাডাম খোঁজ নিয়ে তাকে একই কথা জানায়। আর বলে, এভাবেই মধ্যসত্যভোগিরা তোমাদের রক্ত পানি করা উপার্জনে ভাগ বসায়, কেড়ে নেয় গ্রাস। 
সেলিম এখন মতিনকে ধরতে বাড়িও যেতে পারে না। সেখানে একদিকে সে তার নতুন বিয়ের কথা ফাঁস করে দিয়ে জেলে নেয়ার ভয় দেখায়- অন্যদিকে পাওনাদাররা তারে ছিড়ে খেয়ে ফেলবে। মতিন তাদেরকেও বুঝিয়েছে যে, সেলিম তাদের টাকা খেয়ে ফেলিছে। পাওনাদারের ভয়েই সে বাড়ি যেতে পারে না। নইলে জয়নবরে বুঝাইয়ে সুঝাইয়ে ঠিকই ম্যানেজ করতি পারতো। অবলা-অল্প শিক্ষিত মাইয়ে মানুষ, দিল নরম। কতক্ষণ আর স্বামীর ওপর গোস্বা কইরে থাকতি পারত তার ওপরে সন্তান আছে না! বেড়ি তো পরানোই আছে, পাখি চাইলেই উড়াল দিতে পারব না। কিন্তু আরেক জ্বালা বাধাইয়ে বসিছে স্বয়ং বিজলি। যার জন্য করি চুরি সেই কয় চোর! 


বিজলির যেমন চেহারা, শরীরের গঠন তেমনি তার মনের জোর। সে কিছুতেই সতীনের ঘর করবে না। বিজলি জন্মের পর তার বাপকে দেখে নাই। একটু বড় হতে হতে তার মা ও গেছিল অসুখে ধুকে ধুকে। শরীরে যৌবনের রেখা ফুটে ওঠার আগেই এক বুড়ো রাজমিস্ত্রীর সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেয় মামারা। বুড়োর তখন কাজ কাম করার ক্ষমতা নাই, নাই কোন উত্তাপ কিন্তু বিয়ার শখ যায় নাই। বিজলি বুড়ার ঘর যত না করছে তার চেয়ে সতীনদের লাথি ঝাটা খেয়েছে বেশি। কোনো এক আমাবশ্যার রাতে বুড়ো মরে গিয়ে তাকে মুক্তি দিলে সে ৪১ দিন না পেরোতেই মতিন মিঞার দলের সাথে রাস্তার কাজ করতে চলে আসে এই বরিশালে। বিজলির তখন পচিশ বছরের ভরা যৌবন। সবাই তার দিকে কি এক বিশেষ চোখে তাকায়। তবে বিজলির কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে তারা কাছে ঘেঁষতে পারে না। তবে সেলিমের সাথে তার একটু ভাব হয়ে যায়। এই মানুষটা তার দিকে ঐ ভাবে রক্তচোষার মতো চায় না। চোখদিয়ে তার শরীর চাইটা ফেলে না। তার সাথে এমন ভাবে কথা কয় যেন তার ভেতরের সব শুন্যতা ভরে যায়। কথায় কথায় তার সাথে তামাসা করে অথচ রাগবার ফুরসত দেয় না। বিজলি হেসেই মরে। সারাজীবনে তারে এভাবে হাসাতে পারে নাই কেউ। পারে নাই শুধু কথা দিয়ে তার শুন্যতাকে ভরিয়ে দিতে। বিজলি সেলিমের প্রেমে পড়ে গেলেও ঐ তার বউ ছেলে-মেয়ে বাধা হয়ে দাড়ায়। বিজলি র জীবনটাই এমন। কোন একজন সম্পূর্ণ মানুষ তার সমস্ত মন প্রাণ তারে দিতে পারবে না। এমন কেউ কি নাই দুনিয়ায় যার মনের কোনো অংশ কোথাও বান্দা পইড়া নাই। পুরাডাই তার এবং তার সন্তানের হবে। যেখানে অন্য নারীর সন্তান এসে ভাগ বসাবে না। 
বিজলিরে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিনই শরীরে কি এক শিরশিরানি অনুভব করেছিল সেলিম। ঠিক ঐ রকম একটা অনুভূতি.. ঠিক ঐ রকম। সেই যে সময়ে সে কিশোর বয়সের খোলস ছাড়িয়ে একজন পুরুষ হয়ে উঠছিল। ভাদ্র মাসের শেষ দিক থেকে তার ঘোরাঘুরি বেড়ে যেত পাল পাড়ার রাস্তায়। সারি সারি খড় প্যাঁচানো দূর্গা মূর্তি। একসময়ে দোমাটির আস্তর পড়ে পূর্ণ আকৃতি ধারণ করে। তখনো তিনি বস্ত্রহীনা উদ্ধত যৌবনা। ঐ মূর্তি যেন সত্যি সত্যিই এই পৃথিবীর মানবী না। সে পুরুষ নামক মানুষের কল্পনা। এতো নিখুঁত শরীর! কিসের এক অজানা মোহে সেলিম ছুটে ছুটে চলে যেত ঐ পাড়ায়। সার বাধা নগ্ন মূর্তি..। সেই মূর্তিই একদিন যে বিজলির রূপ ধরে তার সামনে এসে দাড়াবে এ যেন তার কল্পনায়ও ছিল না। বিজলি! না এতো সেই ! সেই একই শরীরের বাঁধুনি, ঠিক যেন পুরুষ পালেরা তারে গড়েছে। ঝুড়ি ভরে পাথর এনে রাস্তায় ফেলার সময় যখন মুহূর্তের জন্য তার স্তন কেঁপে ওঠে তখন যেন দুলে ওঠে সেলিমের গোটা দুনিয়া। তার ভেতরের জান্তব পুরুষ! তবে সে অন্য সবার মতো মানুষ খেকোর চোখে চায় না বিজলির দিকে। সে সব কিছু ভুলে বিজলির পেছন পেছনই ঘোরে। কি এক অজানা মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে। আর সেই কথাটা জানাতেই বিজলিদের ঘরে সেদিন ভরসন্ধ্যায় যখন ঢুকলো এমন সময় কোথা থেকে যেন মতিনও এসে হাজির। 
- কিরে দোস্ত রঙ তামাশার কথা যা শুনি তা-ই তো সত্যি দেখতাছি। 
সেলিম সরল বিশ্বাসে বলল, হয় কতা সত্যি, তা এখন কি করি কও তো। 
- কিন্তু দোস্ত বিজলিরেতো আমারও পছন্দ সে আমার কাছে না আইসে তোমার মধ্যি কি খুঁইজে পালো কওতো। 
এবার বিজলি ঝাঝিয়ে ওঠে, আমি কারো মধ্যেই কিছু খুঁজে পাই নাই তোমরা এবার যাও তো! 
- অত সহজে তো যাওয়া যায় না বিজলি। তোগের ফষ্টি নষ্টির কথা সেই কবেত্তে শুনতি শুনতি তয় আসলাম আইজ। আর যখন হাতে নাতে ধরা পড়লি তহন না করতিছিস কেন রে। এডা কি মগের মুলুক নাকি? 
- না মগের মুলুক না, তয় ঐ সতীনের ঘরে আমি আর যাতি চাইনা। অনেক সয়েছি আর না। আর ঐ সেলিমের যদি এতই শখ থাকে আগের বউরে তালাক দিক। 
- ঐসব পিরিতের কতাতো এহন শুনতি পারব না, সমাজ বইলেতো একটা কতা আছে। এমন হাতে নাতে ধরা পইড়েছ এখন হয় বিয়ে কর নইলে শাস্তি খাও। 
- কি শাস্তি? 
- সে খুব কঠিন কিছু না, ঐ আমাগো সাথেও প্রতি রাইতে একটু ফষ্টি নষ্টি...। 
- কি কস তুই হারামজাদা..! খেকিয়ে ওঠে সেলিম। 
- মুখ সামলাইয়া কথা কইস.., তোরা কি করস আমরা জানি না ভাবিছ..! 
এভাবে অনেক তর্ক বিতর্ক বিচার শালিস হতে পারত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব কিছুই হলো না। সেলিমের বিয়েতে আপত্তি কখনোই ছিল না আর কুলটা হওয়ার অপবাদ ঘোচাতে বিজলি ও রাজি হয়ে যায় তবে শর্ত একটাই, সতীনের ঘর করবে না সে।

বিজলিকে বিয়ের পর সেলিম প্রায় সবই ভুলে ছিল। এই দেড় বছরে সে বাড়িও যায় নাই। কিন্তু যতই এখানকার কাজ শেষ হয়ে আসছিল ততই তার মনের ভেতর খচ খচ করছিল। বাড়ি যাবে না এখন কোথায় যাবে সে! তার ভিটে মাটি সেখানে, আছে বুড়ো বাপ, ছেলে মেয়ে আর জয়নব..! বিজলি যে কিছুতেই রাজি হয় না, কারে রেখে কারে ধরে সে! এরই মধ্যে একদিন রাগের মাথায় বিজলি বলে বসে, ‘দেশে মরদের কি অভাব আছে নাকি, যে সতীনের ঘর করতি অবে!’
আর এরপরই একদিন গোপনে জয়নবকে ফোন করে সে। জানায় মতিনের টাকা মেরে দেবার কথা। তার আসতে না পারার কথা...।

এসব শুনে জয়নব সরল বিশ্বাসে চলে আসে তার স্বামীর কর্মস্থলে। ঠিকাদারি ফার্ম থেকে টাকা গুলো পাবার আশায় ছুটে আসে এখানে। জয়নব আসাতে পরিস্থিতি এখন অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। জয়নব যে এখানে এতদূর একা একা চলে আসতে পারবে এটা ছিল সেলিমের কল্পনারও বাইরে। সে এতসব কবে শিখল!
সেলিম তার অপরাধ ঢাকতে একের পর এক মিথ্যা বলে চলেছে একদিকে ফুলি ও অন্যদিকে জয়নবের কাছে। জয়নব দিশেহারা, বিজলি স্থবির-অনড়। 


এর দুদিন পর সন্ধ্যায় ঐন্দ্রিলা যখন তার দোতলার বারান্দায় অর্কিডের টবে স্প্রে করছে এমন সময় দারোয়ানের সাথে সেলিম ও তার দুই স্ত্রীকে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখল। জয়নবের কিছুটা বিচলিত ভাব তবে বিজলিবানু স্থির অবিচল, মুখের পেশী টান টান।

রাজা অষ্টম এ্যাডওয়ার্ডের কথা শোনেনি কখনো সেলিম। শোনার প্রশ্নও ওঠে না। প্রেমের জন্য বৃটিশ সিংহাসন ছেড়ে দেয়া এই বৃটিশ রাজপুরুষের কথা এদেশের সাধারণ একজন শ্রমিকের জানার কথাও নয়, হোক না সে যতবড় প্রেমিকই। প্রেম ব্যাপারটা সবার জন্য হলেও এসব উদাহরণ শিক্ষিত ভদ্রজনদের জন্যই। সেলিম হয়তো তার নামের সাথে মিলে যাওয়া শাহজাদা সেলিম নামক অপর রাজপুরুষের কথাও জানে না। আচ্ছা, শাহজাদা সেলিম এর নামে মানুষ তার সন্তানের নাম রাখে কেন? শুধুমাত্র তিনি ভারত বর্ষের সম্রাট ছিলেন বলে? নাকি প্রেমিক সম্রাট ছিলেন বলে! তবে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্রাজ্য পাওয়া এই শাহজাদার সৌভাগ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হয়তো লোকে তার সন্তানের নাম রাখে। তার বহু নারীর প্রেমিক হিসেবে পাওয়া স্বীকৃতির জন্য নয় নিশ্চই! 

তবে সে অর্থাৎ আজকের সেলিম এক্ষেত্রে তার নামের সৎ ব্যাবহারই করে বসেছে। অর্থাৎ এ যুগের সেলিমরাও তাদের বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। তারা প্রেমের জন্য কিছুই ত্যাগ করবে না। এ যুগে এসেও ঐ আনারকলিদেরকেই পুরুষের বিনোদনের খেসারত দিতে জিন্দা কবরে যেতে হবে। সতীনের সংসার নামক জিন্দা কবর!

কিন্তু সতীনের সংসার না করার শর্তে অনড় থাকে বিজলি, সে চলে যাবে অন্য কোথাও। অন্য কোনোখানে, একা..। ঐ ভুল মানুষের সাথে না। একথা বলতেই এসেছে সে আজ।

এ যুগের আনারকলিরা জিন্দা কবরে বলি হবে কেন? তারা আজ সম্পূর্ণা। আজকের পৃথিবী যে তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে তার সাহস ও কর্মকে বরণ করার জন্য। তাই বিজলির সাহসকে শ্রদ্ধা জানাতে, আর ওর কর্মকে শুভকামনা জানানোর জন্য ঐন্দ্রিলা স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, ভালো থেকো ..। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত