‘ফাতেমা খালা’র জন্য সেই প্রতীক্ষিত রিকশা! (ভিডিও)
প্রকাশ | ১৯ জুন ২০১৬, ০১:৩০ | আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬, ০১:৪৯
গত বছরের নভেম্বরের শেষদিকের ঘটনা। বাসা থেকে অফিস যাওয়ার পথে এক নারী রিকশাচালকের দেখা পান চট্টগ্রামের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সৃজিতা মিতু। কিছুটা বিস্ময় থেকেই সেদিন সেই নারী রিকশা চালক এর সাথে তার কথোপকথন। সাহসী সেই নারীর নাম ফাতেমা। যিনি সমাজের বক্রদৃষ্টি উপেক্ষা করেই রিকশা চালানোর মতো একটি কঠিন পরিশ্রম ও চ্যালেঞ্জিং কাজকে আপন করে নিয়েছিলেন। সমাজের বিরুদ্ধে যার সাহসী উচ্চারণ ছিল, “মানুষ কি আমারে খাওয়ায় নাকি মা? নিজে কষ্ট করে রোজগার করি। কে কি বলে তা কানে নিয়ে লাভ কি!”
একজন নিম্নবিত্ত নারীর এমন সাহসী বক্তব্যই সৃজিতার মনে ভীষণ দাগ কাটে। রিকশা থেকে গন্তব্যস্থলে নেমে তাই সেদিন রিকশা চালক ফাতেমা খালার মোবাইল নম্বরটাও নিজের কাছে রেখে দেন। সেদিন সৃজিতা মিতুর সাথে ফাতেমা খালার সেই কথোপকথনই ছাপা হয় অনলাইন পত্রিকা সিলেটটুডে২৪ এর পাতায় যা নজরে আসে সারা দেশে অসংখ্য মানুষের। সেই রিপোর্টের সূত্র ধরেই একজন বিস্তারিত জানতে চান ফাতেমা খালার সম্পর্কে। খোঁজ নিতে খালার বাসায় উপস্থিত হন সৃজিতা মিতু। ছোট্ট এক রুমের সংসার উনার। স্বামী সেই কবেই আরেকটি বিয়ে করে চলে গেছে। দু’টি সন্তান স্কুলে পড়ে। এই সব খরচ একা চালান ফাতেমা খালা। পরিশ্রমে শরীরটা অসুস্থ হলে আয়ের পথও বন্ধ হয়ে থাকে।
কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, ভাড়ায় রিকশা চালান ফাতেমা। যা আয় হয় তার অনেকটা ভাড়া দিতেই চলে যায়। নিজের একটা রিকশা কেনার ইচ্ছে হলেও সাধ্য নেই! পুরনো ব্যাটারি চালিত রিকশার দামও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। যা আয় হয়, রিকশা ভাড়া, ঘরভাড়া, ছেলেদের খাওয়া-পড়ার খরচ আর নিজের খাওয়া খরচের পর আর জমানোর জন্য কিছুই থাকে না।
সৃজিতা মিতু বলেন, “সেইদিন বাসায় ফিরে সেই ভাইয়াকে জানাই সব। তার কিছুদিন পর উনি ১০ হাজার টাকা পাঠান খালার ডাক্তার খরচ ও চলার জন্য। সেই টাকা হাতে পাওয়ার পর খালার খুশি দেখে কে! সেই ভাইয়া উনাকে একটা রিকশা কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু যেকোনো কারনে হোক উনি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। কিন্তু আমিতো খালাকে আশা দিয়ে ফেলেছিলাম। 'খালা আপনার জন্য আগামী মাসে নতুন রিকশা আসবে।' কিন্তু সেই আগামী মাস আর আসেনি। খালা আশা নিয়ে বসে ছিলেন। একদিন খালাকে কল করেছিলাম খোঁজ খবর নিতে। খুব খারাপ লাগছিল বলতে, 'খালা আপনার রিকশা কিনার জন্য যে ভাইয়ার টাকা দেয়ার কথা, তিনি একটু সমস্যায় আছে। তাই দেরি হচ্ছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। '
খালা বলেছিল... 'আমি একটা মা পাইছি। আমার রিক্সা দরকার নায়’।”
একার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু অনেকের প্রচেষ্টায় সম্ভব, এই তাড়না থেকেই ‘ফাতেমা খালার জন্য একটি রিকশা’ নামে সবার কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে এই মাসের শুরুর দিকে ফেসবুকে একটি ইভেন্ট খুলেন সৃজিতা মিতু এবং প্রকৌশলী ও সাংবাদিক মারজিয়া প্রভা। তারপর সেই ইভেন্টের মাধ্যমে জেনেই দেশ বিদেশ থেকে অনেকেই টাকা পাঠান ফাতেমা খালার জন্য।
তবে নেতিবাচক কথাও উঠেছে ইভেন্টকে ঘিরে। নারী হয়ে রিকশা চালাবেন কেন? চা/পান এর দোকান দিলেই পারেন এমন একটা ইঙ্গিত ছিল কারো কারো কথায়। কিন্তু আয়োজকরা জানান, ১১ বছর ধরে রিকশা চালান ফাতেমা, তাই তিনি একটি রিকশাই চান। কারণ এই কাজেই তার দক্ষতা বেশি।
অবশেষে সব বাধা পেছনে ফেলে সবার সহযোগিতায় শুক্রবার (১৭ জুন) বিকেলে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ে নন্দন বইঘরের সামনে ফাতেমার হাতে তুলে দেয়া হয় একটি নতুন রিকশা। এছাড়া নগদ আরও ৫ হাজার টাকা দেয়া হয় ফাতেমাকে।
নতুন রিকশা পেয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেন ফাতেমা। ফাতেমা বলেন, “আমি কল্পনাও করি নাই আমার নিজের একটি রিকশা হবে। আমি আজ খুবই খুশি। যারা আমাকে সাহায্য করেছেন, পাশে থেকেছেন সবার জন্য দোয়া করি, সবাইকে থ্যাংকিউ”।
ফাতেমার জন্য রিকশা কিনতে দেশ-বিদেশের যারা অর্থ দিয়ে কিংবা অন্যভাবে পাশে থেকেছেন, সাহায্য করেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এই ইভেন্ট এর উদ্যোক্তা সৃজিতা মিতু ও মারজিয়া প্রভা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এর সকল ফতোয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো সবার প্রিয় ‘ফাতেমা খালা’র রিকশা এখন চট্টগ্রামের পথে তার স্বপ্ন ও সাহসের মতোই যেন উড়ে উড়ে যায়।