‘যখন মন চাইত, তখনই যৌন নির্যাতন করত’
প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০১৭, ২১:২৫
‘সেই রাতে লোকটা আমাকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে যায়। আমি খুব কাঁদছিলাম। লোকটা বলছিল, আমি তোকে কিনে এনেছি, আমি যা চাই তা-ই করতে পারি। আমি তোর মা-বাবাকে টাকা দিয়েছি। যত দিন ইচ্ছে আমি তোকে ব্যবহার করব। মুখ বন্ধ রাখ।’
কথাগুলো ভারতের হায়দরাবাদের ১৯ বছরের আসমা বেগমের (ছদ্মনাম)। আসমা বলেন, তার মা-বাবা বিয়ের নামে যখন জোর করে তাকে বিক্রি করে দেন, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। আর ওমান থেকে আসা ওই ব্যক্তির বয়স ছিল ৭০ বছর। মানুষের জীবনে বিয়ে এক মধুর স্মৃতি হলেও আসমার জীবনে এই স্মৃতি ‘নির্যাতনের’।
আসমা তার দুঃসহ জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে সিএনএনকে বলেন, ‘আমি পড়াশোনা জানতাম না। তাই আমার সঙ্গে কী হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। আমার মধ্যে তখনো শিশুসুলভ আচরণ ছিল। দুই মাস এই লোকটা আমাকে এক ঘরে বন্দী করে রাখল আর যখন মন চাইত, তখনই যৌন নির্যাতন করত। যদি লোকটা কোথাও যেত, তাহলে আমাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে যেত। আর ফিরে আবারও একই নির্যাতন শুরু করত।’
পুলিশ জানায়, আসমার মতো হায়দরাবাদের ওল্ড সিটিতে এমন শত শত ঘটনা আছে। গরিব ঘরের মা-বাবা তাদের কম বয়সী মেয়েদের সম্মতি ছাড়াই অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। আর তাদের খরিদ্দার হলো বয়স্ক পর্যটক, যারা যৌনতার জন্য এখানে আসে।
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এসব খরিদ্দারের জন্য এজেন্ট রয়েছে। তারা হায়দরাবাদের দালালদের চেনে। এসব দালাল গরিব পরিবারের অভিভাবকদের বুঝিয়ে অর্থের বিনিময়ে মেয়েকে বিক্রি করাতে রাজি করায়। খরিদ্দারেরা সাধারণত বয়স্ক পুরুষ। তারা হায়দরাবাদে আসার পর দালালদের দেখানো মেয়েদের মধ্য থেকে একজনকে পছন্দ করে।
এ অপরাধী চক্রের একজন অংশীদার হলেন কাজি। তিনি এ-সংক্রান্ত বিয়ের সনদে সই করেন এবং আগের তারিখ উল্লেখ করে বিবাহবিচ্ছেদ সনদে সই করেন। অথচ ঊর্ধ্বতন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ইসলামি আইন অনুযায়ী বিয়ের সময় মেয়ের সম্মতি প্রয়োজন।
ওই খরিদ্দারেরা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর তাঁর কিশোরী স্ত্রীকে ফেলে চলে যায়, আর ফেরে না। এর মধ্যে অনেক মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়। অনেক খরিদ্দার আবার তার সঙ্গে রাখা মেয়েটিকে মাদক দিয়ে অসহায় অবস্থায় নিয়ে যায়।
একজন মা কীভাবে তার মেয়েকে বিক্রি করেন, বিষয়টি অকল্পনীয় হলেও আসমা বেগমের মা নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই মেয়েকে বিক্রি করেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, হায়দরাবাদের দরিদ্র এলাকাগুলোর একটিতে পাঁচজনের পরিবার নিয়ে একটি কক্ষে কোনো রকমে তাঁরা থাকেন। স্বামী মদ খায়। ঘরে উপার্জনের কেউ নেই। তাই তিনি মনে করেছেন, মেয়েকে বিক্রির পর সেই অর্থ দিয়ে তাদের পরিবারে সুদিন ফিরবে।
আসমার মা বলেন, ‘মনে করেছি, মেয়েকে বিক্রির ওই টাকা দিয়ে আমরা ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকতে পারব। আমাদের এবং মেয়ের জীবনের উন্নতি হবে। এসব চিন্তা করেই এমনটা করেছি।’
আসমার ঘরে এখন এক কন্যাসন্তান। বিয়ের দুই মাস পরই তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। কিন্তু তার স্বামী ওমানে ফিরে গিয়ে ফোনে তাকে তালাক দেয়। সে সময় আসমা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। আসমা বলেন, ‘আমি সারা দিন শুধু কাঁদতাম। মনে হতো আমার জীবনটা অর্থহীন হয়ে পড়ল। শেষবার আমি আমার কবজি কাটতে চেয়েছি।’
ওই সময় শাহিন নামের একটি এনজিও এগিয়ে আসে। তাকে নিয়ে যায়। এই সংস্থাটি বিয়ের নামে জোর করে মেয়েদের বিক্রি ঠেকাতে কাজ করে।
শাহিন এ ধরনের মেয়েদের উদ্ধারে করে তাদের পুনর্বাসন করে। তাদের কাপড় সেলাই, মেহেদি পরানো বা কম্পিউটার শেখানোর মতো বিভিন্ন কিছু শেখায়। মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করে।
২০ বছর আগে জামিলা নিশাত নামের এক নারী এই শাহিন গড়ে তোলেন। তিনি এই সংস্থার মাধ্যমে সরাসরি শতাধিক মেয়েকে সহায়তা করেছেন। আর পরোক্ষভাবে এক হাজার। জামিলা বলেন, ‘আমার স্বপ্ন, প্রত্যেক মেয়ে জীবনে সুখী ও সর্বোচ্চ উপভোগ করবে এবং নিজেকে স্বাধীন ভাববে।’
শাহিনের কাছে আশ্রয় পাওয়ার পর আসমা মামলা করেন। তাকে বিক্রির সঙ্গে জড়িত মধ্যস্থতাকারী এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর কোনো মেয়ের জীবন এমন হতে দেওয়া হবে না বলে অঙ্গীকার করেছেন আসমা। তার কথা, ‘আমার হৃদয়ে যে ক্ষত, আর কেউ যেন এমন কষ্টের মুখোমুখি না হয়।’
সূত্র: প্রথম আলো