ফিলিস্তিন আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক লায়লা খালেদ
প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০১৬, ০০:১০
রোমান হলিডে খ্যাত বিখ্যাত অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের সাথে চেহারার সাদৃশ্য ছিল তাঁর। অমনই উঁচু হয়ে থাকা ধারালো চোয়ালের হাড়, উজ্জ্বল চুল, ঝিলিক দেওয়া চোখ। হেপবার্নের মতই অভিজাত সৌন্দর্য তার। তার মতো করেই পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবিসহ খবর হতেন তিনি। না, অভিনয় জগতের কেউ তিনি নন হেপবার্নের মতো। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতের মানুষ ছিলেন তিনি। তারপরেও বিশ্বব্যাপী প্রচারণায় পিছিয়ে ছিলেন না কারো চেয়ে। সত্তরের দশকের অন্যতম আলোচিত নারী তিনি। বিপুল সময়ের ব্যবধানে আড়ালে চলে গেছেন আজ। কিন্তু, একেবারে হারিয়ে যান নি মানুষের স্মৃতি থেকে। কেউ না কেউ ঠিকই মনে রেখেছে আজো তাকে।
এই অপরূপা নারীটির নাম লায়লা খালেদ। ফিলিস্তিন আন্দোলনের অন্যতম এক লড়াকু সৈনিক তিনি। সাড়ে চার দশক আগে, তার যৌবনে একের পর এক বিমান ছিনতাই করেছেন দেশহারা ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামকে বেগবান করতে। গ্রেনেড, বন্দুক, গুলি ছিল তার নিত্যসঙ্গী। মেয়েরা যেখানে আঙুলে সোনার আংটি পরে, তিনি সেখানে গ্রেনেডের পিন দিয়ে মোড়ানো বুলেট পরতেন তার ডান হাতের চতুর্থ আঙুলে। প্রশিক্ষণের সময় তার ছোড়া প্রথম গ্রেনেডের পিন দিয়ে এই অঙ্গুরি বানিয়েছিলেন তিনি।
লায়লা খালেদের জন্ম ১৯৪৪ সালে ফিলিস্তিনের হাইফা শহরে। তার জীবনের প্রথম চার বছর শান্তিপূর্ণই ছিল। ১৯৪৮ সালের ১৩ই এপ্রিল এই এলাকায় যুদ্ধের কারণে আরও আশি হাজার ফিলিস্তিনের সাথে লায়লা খালেদরাও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে আসেন লেবাননে। এখানেই রিফিউজি ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা তার প্রবল দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অসুস্থ সময়ের মধ্যে।
১৯৬৩ সালে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতে মেডিকেলের ছাত্রী ছিলেন তিনি। কিন্তু, তার বাবার পক্ষে এক সন্তানের চেয়ে বেশি কাউকে আর্থিক সাহায্য দেবার সক্ষমতা ছিল না। লায়লার বাবা লায়লার পরিবর্তে তার ভাইকে খরচ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। লায়লার বড় ভাই কুয়েতে চাকরি করতো। এই বড় ভাই এগিয়ে আসে লায়লার খরচ জোগাতে। তারপরেও শেষ রক্ষা হয় না। পয়সার অভাবে ডিগ্রি ছাড়াই ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে আসতে হয় তাকে।
তার বড় ভাই ফিলিস্তিনি আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল ছাত্র থাকা অবস্থায়। এই বড় ভাইয়ের পথ ধরে লায়লাও এই পথে পা বাড়ান। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন তখনও তাদের সশস্ত্র অংশে মেয়েদের নেবার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু, জর্জ হাবাসের নেতৃত্বাধীন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাইকে অস্ত্রের ট্রেনিং দিতো। স্বাভাবিকভাবেই লায়লা খালেদ পিএফএলপিতে যোগ দেন।
১৯৬৯ সালের ২৯শে অগাস্ট। রোম এয়ারপোর্ট থেকে তেল আবিবের দিকে রওনা দিয়েছে টিডাব্লিউএ ৮৪০। সেভেন ও সেভেন বোয়িং বিমান। পেটের ভিতরে একশো চল্লিশজন যাত্রী। আকাশেই বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন অস্ত্র এবং গ্রেনেড সজ্জিত লায়লা খালেদ এবং তার সহযোদ্ধা সেলিম ইসায়ি। সেলিমও তার মতই হাইফা থেকে আগত শরণার্থী। টিডাব্লিউএ এর এই বিমান ছিনতাইয়ের মূল উদ্দেশ্যে ছিল একজনকে আটক করা। তিনি হচ্ছেন আইজ্যাক র্যাবিন। তিনি তখন আমেরিকায় ইজরাইলের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচার করা। লায়লাদের দুর্ভাগ্য, সেই প্লেনে আইজ্যাক র্যাবিন ছিলেন না।
প্লেনের পাইলট কয়েকবার চুপিসারে প্লেনকে ত্রিপলিতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। ত্রিপলিতে আমেরিকান মিলিটারি বেজ ছিল। প্রতিবারই লায়লা বিষয়টা ধরে ফেলেন। প্লেনের বিষয়ে প্রশিক্ষিত ছিলেন তিনি। ত্রিপলি বা তেল আবিবের দিকে না গিয়ে এল ল্যাড এয়ারপোর্টের দিকে যাবার জন্য বিমানের ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দেন তিনি। এল ল্যাড তখন নতুন নাম নিয়েছে ইজরাইলের মাধ্যমে। এর নতুন নাম লডি। ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করেন, “ইজরাইলের লড এয়ারপোর্টে যেতে বলছেন?” “না, এল ল্যাডে যেতে বলছি। এই নাম হাজার বছর ধরে চলে আসছে। ইহুদিরা ইচ্ছা করলেই তা বদলে ফেলতে পারে না” কঠোর গলায় লায়লা বলেন।
এল ল্যাডে এসে বিমানকে ১২০০ ফুটে নেমে যেতে বলেন লায়লা। ইজরাইলি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারকে নির্দেশ দেন টিডাব্লিউএ ৮৪০ কে পিএফএলপি নামে ডাকার জন্য। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার স্বাভাবিকভাবেই অস্বীকৃতি জানান এই নামে ডাকতে। তখন যাত্রীবাহী বিমানের ক্যাপ্টেনের মাধ্যমে লায়লা বার্তা পাঠান এই বলে যে এই প্লেনে একশো চল্লিশজন যাত্রী জিম্মি রয়েছে। তাদের ভালো চাইলে পিএফএলপি নামে যেন এই বিমানকে ডাকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। এই হুমকির পরে বেচারা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের আর কোনো উপায় থাকে না। চাপে পড়ে বিমানকে হাইজাকারদের পছন্দের নামে ডাকলেও ওই বিমানকে এল ল্যাডে নামার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
বিমান ইজরায়েলে ঢোকার পর থেকেই ইজরাইলি বিমান বাহিনীর দুটো মিরেজ জঙ্গি বিমান এসে হাজির হয়েছিল। টিডাব্লিউএ ৮৪০কে এল ল্যাডে নামতে বদ্ধ পরিকর থাকে তারা। বিমানের নিচে এসে অবস্থান নেয় তারা এজন্য। ভড়কে না গিয়ে লায়লা তার নির্দেশ অব্যাহত রাখে। ক্যাপ্টেনকে বাধ্য করে অবতরণ চালিয়ে যেতে। বেদখল হওয়া বোয়িং এর একগুঁয়ে আচরণ দেখে মিরেজ দুটো দুই পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়।
এল ল্যাডে অবতরণের আগেই সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে হঠাৎ করেই মত পরিবর্তন করেন লায়লা। “হাইফাতে চলো। আমি আমার জন্মশহর দেখতে চাই খুব কাছে থেকে।”
লায়লার আদেশে সেভেন ও সেভেন খুব নিচু হয়ে হাইফা শহরের উপর দিয়ে চলতে থাকে। শহরটাকে দুইবার বৃত্তাকারে ঘুরে আসে বিমান।
হাতে তাজা গ্রেনেড নিয়ে দুনিয়ার সমস্ত কুৎসিতকে ভুলে গিয়ে তরুণী হাইজাকারটি বিমানের জানালায় মুখ লাগায়। তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো অনন্তকাল তাকিয়ে থাকে জন্মভূমির দিকে । চোখের কোণ জমা হতে থাকে শিশিরের মতো টলমল অশ্রুবিন্দু।
ফেলে আসা জন্মশহরে আর কোনো দিন ফেরা হবে না তার।