ধর্ষণ, মারধর, অতঃপর জীবনযুদ্ধে যেভাবে জয়ী হলেন জেসমিন

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:০০

অনলাইন ডেস্ক

নাম তার জেসমিন এম মুসা। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই তার জীবন চলছিল। ভারতের কেরালার কালিকটের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম মুক্কাম। সেই গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তার জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। সে দিন সবেমাত্র স্কুল থেকে ফিরেছিলেন তিনি। স্কুলের পোশাক খোলার আগেই মা এগিয়ে এসে তার হাতে চায়ের কাপ ভর্তি ট্রে ধরিয়ে দিলেন।

বাড়িতে তখন ভর্তি লোকজন। তাদের চা পরিবেশন করে, তাদের কথার সমস্ত উত্তর দেন। তারপর অতিথিরা চলে যাওয়ার পর বাড়ির লোকজনের কথাবার্তায় বুঝলেন, তারা তাকেই দেখতে এসেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন জেসমিন। তিনি যে বিয়ের জন্য একেবারেই প্রস্তুত নন, তা বারবার বাড়ির লোককে জানিয়েও কোনও ফল মেলেনি।

বাড়ির লোকও কোনওরকম খোঁজখবর না নিয়েই এর এক সপ্তাহের মধ্যে তার এনগেজমেন্ট করিয়ে দেন। আর তার তিনদিন পর জেসমিন ১৮ বছর বয়সে পা দিলেই বাড়ির লোকজন তার বিয়ে দিয়ে দেন।

কার সঙ্গে তার বিয়ে হতে চলেছে, সেটাও জানতেন না তিনি। বিয়ের দিনই প্রথম স্বামীর মুখ দেখেন। বিয়ের রাতে যখন তার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন স্বামী, তখনই স্বামীর আচার-ব্যবহারে কিছু অস্বাভাবিকত্ব দেখেছিলেন জেসমিন। তাকে ধর্ষণ করতে শুরু করেন স্বামী। আর সারারাত চিৎকার করতে থাকেন জেসমিন। কিন্তু জেসমিনের দুর্ভাগ্য, চিৎকার শুনেও কেউ একবারও তার খোঁজ নিতে আসেননি। বরং এটাই খুব স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হত তাদের এলাকায়। কারণ বেশির ভাগ মেয়েরই খুব কম বয়সে বিয়ে হত। আর তাই বিয়ের প্রথম রাতে এমন আর্তনাদ যেন সকলের কাছেই গা সওয়া ছিল।

জেসমিনের জীবনে বিয়েটা একটা অভিশাপের মতো ছিল। রোজই তাকে ধর্ষণ করতেন স্বামী। বিয়ের মাস খানেক পর তিনি বুঝতে পারেন, তার স্বামী আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ। বিয়ের এক বছর পর বিবাহবিচ্ছেদ, বাপের বাড়ি চলে যান জেসমিন। কিন্তু তখনই জেসমিনের সমস্যা দূর হওয়ার ছিল না। সমাজ নানাভাবে তাকে অপ্রস্তুত করে তুলতে শুরু করে। পরিবারের কাছেও ক্রমে একটা বোঝায় পরিণত হয়েছিলেন জেসমিন। তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে পরিবার।

কিন্তু এবারে বিয়ের আগে স্বামীর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার জেদ ধরে বসেন জেসমিন। তার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল জেসমিনের। ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন, তেমনটাই স্বামী পেতে চলেছেন তিনি, এমনই মনে হয়েছিল তার। কিন্তু অবাক হওয়ার অনেক বাকি ছিল।

বিয়ের প্রথম রাতে কোনও কারণ ছাড়াই স্বামী তাকে মারধর শুরু করেন এবং হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করেন। তারপর থেকে প্রতিটা রাতই জেসমিনের কাছে বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল। তার দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন মাদকাসক্ত। ড্রাগের নেশায় প্রতিরাতে এভাবেই তার ওপর নির্যাতন চালাতেন। কাউকে না জানানোর হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন জেসমিনকে।

জেসমিনও ভয়ে গুটিয়ে থাকতেন। বাঁচার ইচ্ছাই চলে গিয়েছিল তার। এর মধ্যেই তার জীবনে বাঁচার প্রেরণা এসে হাজির হয়। জেসমিন অন্তঃসত্ত্বা হন। কিন্তু স্বামী সেটা জানতে পারার পরই রেগে গিয়ে তার পেটে লাথি মারেন। রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। জেসমিন তখন পাঁচ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তার ইউটেরাস এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, তার বাচ্চাকে বাঁচানো যায়নি। পুরো বিষয় জেসমিন বাড়ির লোককে জানান। ইতোমধ্যে স্বামী তাকে ডিভোর্স দিতে চেয়ে কোর্টে আবেদন জানান।

কিন্তু জেসমিন স্বামীর বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য প্রতিহিংসার মামলা করেন। পুলিশ তার স্বামীকে গ্রেফতারও করে। প্রচণ্ড ট্রমায় ছিলেন জেসমিন। বিদেশে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের লোকজন তাকে সেটা করতে দেননি। পাসপোর্ট পুড়িয়ে দেন।

কোচিতে পালিয়ে যান তিনি। সেখানে প্রথমে একটা ফিটনেস সেন্টারের রিসেপশনিস্ট-এর কাজে যোগ দেন। ফিটনেসের উপরে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন বেঙ্গালুরু থেকে। এই মুহূর্তে বেঙ্গালুরুরই একটি ফিটনেস সেন্টারের ট্রেনার তিনি। শারীরিক এবং মানসিক দু’ভাবেই নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছেন। এখন তার মতো প্রতিহিংসার শিকার অন্য নারীদেরও বদলাচ্ছেন জেসমিন। 
সূত্র: আনন্দবাজার