পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিয়ে বন্ধ করছে মাদ্রাসার ছাত্রীরা

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০১৮, ১৮:৪০

জাগরণীয়া ডেস্ক

পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্রীদের একটি বিরাট গ্রুপ বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সমাজ সচেতনতায় ইউনিসেফ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মীনা। বছর পাঁচেক আগে সেই মীনা-র নামেই মাদ্রাসা ছাত্রীরা গড়ে তুলে মীনা মঞ্চ। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দুই ২৪ পরগনার পাশাপাশি হাওড়া, হুগলি ও কলকাতার বিভিন্ন মাদ্রাসায় রয়েছে এ মঞ্চ।

মাদ্রাসাপিছু ২০-৩০ জন ছাত্রী নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। নেতৃত্বে থাকেন একজন শিক্ষক। ছাত্রীদের মধ্যেও একজন নেতা থাকে৷ বছরে মীনা মঞ্চের ২-৩টি কর্মশালা হয়৷ ব্লকভিত্তিক বা জেলাভিত্তিক এই কর্মশালায় হাজির থাকেন ইউনিসেফের সদস্যরা৷

মীনা মঞ্চের মধ্য দিয়ে সামাজিক সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছেন ছাত্রীরা। এর মধ্যে রয়েছে- ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা, এলাকার সমস্যা ও কুসংস্কার দূর করা। এবার তার সাথে যোগ হয়ে বাল্যবিয়ে রোধ।

মুর্শিদাবাদের রানিনগর-২ ব্লকের কোমনগর হাই মাদ্রাসার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সান্তানুর আহ্সানিয়া তার দলের লিডার৷ তিনি জানান, বাবা-মায়েরা মেয়েদেরকে সংসারে  বোঝা ভাবেন৷ তাই তাড়াতাড়ি মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই খুশি হন৷

এই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিমও ছাত্রীর সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, বাল্যবিয়ে দিচ্ছে এমন বাবা-মা-কে ডেকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন এই অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। উত্তরে এক ছাত্রীর মা বলেছিলেন,এ কী পোষার জিনিস! 

তাদের মতে, ছাগল, মুরগি যেমন পোষা হয়, মেয়েটি তেমনই তাদের কাছে তেমনই পোষ্য!

ঐ শিক্ষক আরও বলেন, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এমনই যে, সারাদিন খেটে এসে মেয়ের জন্য পাত্র দেখাটাও তাদের জন্য কষ্টের। তাই ভাল পাত্র পেলেই মেয়েকে বিয়ে দিতে তারা উদগ্রীব হন।

ছাত্রীরা কি বিয়ে না হওয়ায় কষ্ট পায়?

এমন প্রশ্নের জবাবে সান্তানুর বলেন, এই বছরই চারটে বিয়ে আটকেছি। বিয়ে না হলে ছাত্রীরা খুশিই হয়৷ তবে চারপাশে অনেকে আমাদের কথা শোনায়, সেটার পরোয়া করি না৷''

বাল্যবিবাহ রোধে কোমনগর মাদ্রাসার মীনা মঞ্চের শবনম পারভেজ জানালেন, মেয়েরা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝছে৷ অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার কুফল চোখের সামনে দেখে তারা আরো বেশি সচেতন। বাড়িতে বাবা-মায়ের চাপে অনেকে বিয়েতে সম্মতি জানালেও বিয়ে ভেঙে গেলে তারাই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়৷

কীভাবে বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়া হয়?

সান্তানুর বলেন, বাল্যবিবাহের খবর পেলে মীনা মঞ্চের সদস্যের নিয়ে প্রথমে বৈঠক করা হয়।  তারপর ছাত্রীটির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলি। অভিভাবকদের কাছে মেয়েদের শিক্ষার জন্য করা বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন- মিড ডে মিল, ইউনিফর্ম দেওয়া, স্কলারশিপ বা কন্যাশ্রী বৃত্তির কথা তুলে ধরি। তাছাড়া আঠারোর পরে বিয়ে করলে রূপশ্রী রয়েছে৷ সেই সাথে অল্প বয়সে বিয়ে দিলে মেয়েরা কী কী শারীরিক সমস্যায় পড়তে পারে সে বিষয়েও তাদেরকে বুঝাই।

মীনা মঞ্চের প্রথমদিকের বাল্যবিবাহ রোধের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

শবনম জানালেন, অষ্টম শ্রেণির নাসরিন ইয়াসমিনের বিয়ের খবর পেয়ে মীনা মঞ্চের মেয়েরা তা ভেঙে দিয়েছিল৷ ক'দিন পরেই নাসরিনকে মামার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয়া হয়৷ ৬ মাসের মধ্যে ডিভোর্স নিয়ে নাসরিন ফিরে আসে৷ এরপর নাসরিন মীনা মঞ্চে যোগ দিয়ে বর্তমানে অন্য মেয়েদের বাল্যবিবাহ ঠেকাচ্ছে।

শবনম জানালেন, মীনা মঞ্চের মেয়েরা খুবই সক্রিয়৷ বিয়ের খবর ওরাই জোগাড় করে৷ এমনকি কোনো ছাত্রীর বাড়ির আশেপাশে ঘটক ঘোরাফেরা করতে দেখলেও তারা সন্দেহ শুরু করে ৷

ভবিষ্যত পরিকল্পনা 

ইউনিসেফের আঞ্চলিক প্রধান অমৃতা সেনগুপ্ত বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সাতটি জেলায় মীনা মঞ্চ কাজ করছে৷ আরেকটি জেলা যোগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ তাতে আরও বেশি স্কুলছাত্রীদের এই অভিযানে যুক্ত করা সম্ভব হবে ৷

এ প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিম বলেন, মুর্শিদাবাদের সীমান্ত এলাকায় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি না পাল্টালেও মীনা মঞ্চের কাজে সচেতনতা বাড়ছে ৷

শিক্ষক জিয়াউল রহমান বলেন, সচেতনতার যে প্রচণ্ড ঘাটতি ছিল তা অনেকটা উন্নতির দিকে৷ মেয়েরা বিয়ে আটকানোর পরে আবার পড়ালেখার মূল স্রোতে ফিরে আসছে৷ মীনা মঞ্চকে আরো প্রসারিত করলে আরো ভালো হবে ৷

পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে কমপক্ষে ২৫ জনের বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে মীনা মঞ্চ ৷ ২০১৭ সালে মালদহে ১৪ জন ও ২০১৬ সালে উত্তর ২৪ পরগনায় ২২ জনের বিয়ে বন্ধ করেছে মীনা মঞ্চ ৷

সূত্র: ডয়েচেভেলে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত