শেষ শ্রদ্ধায় প্রিয় 'মিতিল আপা'
প্রকাশ | ২২ জুলাই ২০১৬, ১২:২৬ | আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৬, ১৩:১৭
পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন এর সাবেক সভাপতি, বামপন্থী নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তার পরিবার, সহযোদ্ধা, বন্ধুবর্গ ও শুভানুধ্যায়ীরা।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে শুক্রবার সকাল ১০:৩০ থেকে ১১:৩০ পর্যন্ত তার মরদেহ সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয়। সেখানে সবার প্রিয় মিতিল আপাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, বন্ধুবর্গ, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী সহ দেশের বিভিন্ন স্তরের সাধারণ জনগণ। সকলের ভালোবাসায় শেষবারের মতো সিক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল।
এসময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এর সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ এর সভাপতি লাকী আক্তার সহ অনেকে শিরিন বানু মিতিল এর অবদান ও রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মকান্ডের স্মৃতিচারণ করেন ও শ্রদ্ধা জানান।
উল্লেখ্য, বুধবার মধ্যরাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল। এর আগে রাত সাড়ে ১১টায় তিনি হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬৫ বছর।
মহিয়সী এই নারীর জন্ম ১৯৫১ সালের ২রা সেপ্টেম্বর পাবনা জেলায়। বাবা খোন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ও মা সেলিনা বানু। বাবা ছাত্রজীবনে ও ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। মা পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের এমপি ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হবার ফলে নিজেও ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ছোটবেলা থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন এর সাথে যোগ দেন তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এছাড়াও ১৯৭০-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন এর সভানেত্রী এবং কিছু সময়ের জন্য পাবনা জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য স্থানের মত পাবনা জেলাও পাকহানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। ২৭ মার্চ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশলাইনে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয় সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। তাই নারী হয়ে শত প্রতিকূলতার মাঝে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এক আত্মীয়ের কাছে মাত্র ত্রিশ মিনিটে থ্রি নট থ্রি চালনা শিখে ফেলেন। কিন্তু নারী হিসেবে সে সময়কার সমাজে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। তাই তিনি শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতাকে অনুসরণ করে পুরুষের পোশাক পরিধান করে পুরুষবেশে যুদ্ধে যোগ দেন।
২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ জন পাকসেনার সাথে জনতার এক তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেই যুদ্ধে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৩৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। এছাড়াও ৩১ মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। ৯ এপ্রিল নগরবাড়িতে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
এরপর ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানব ঘোষ তাঁর ছবিসহ পুরুষ সেজে যুদ্ধ করার খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করে দিলে তাঁর পক্ষে আর পুরুষ সেজে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁর যুদ্ধ থেমে থাকেনি। পরবর্তীতে পাবনা শহর পাকবাহিনী দ্বারা দখল হলে তিনি ২০ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত একমাত্র নারীদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গোবরা ক্যাম্পে যোগ দেন। পরবর্তীতে মেজর জলিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯নং সেক্টরে যোগ দেন।